December 25, 2024, 8:47 am
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সুহিলপুর ইউনিয়নের ঘাটুরা গ্রামের অধিবাসী জনাব আব্দুর রাজ্জাকের কন্যা মোছাম্মত স্বপ্না আক্তারের নবজাতক শিশুর তিন দিনের দিন মৃত্যু ঘটলে তাকে গত ৯ জুলাই ঘাটুরা সরকারি কবরস্তানে দাফন করা হয়। কিন্তু দাফনের কিছুক্ষণ পর উগ্র-ধর্মান্ধরা তিন দিনের এই নবজাতক নিষ্পাপ শিশুকে কবর থেকে তুলে রাস্তায় ফেলে রাখে। এই শিশুর ‘অপরাধ’ সে ঘাটুরা নিবাসী এক আহমদীয়া মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিল। যদিও পরে প্রশাসনের নির্দেশে মৃত নবজাতকের পরিবারের সদস্যরা উপড়ে ফেলা সেই লাশ নিয়ে দশ কিলোমিটার দূরে অন্য আরেক কবরস্তানে দাফন করে। ঘাটুরায় ঘটে যাওয়া এই পৈশাচিক ঘটনা উগ্র-ধর্মান্ধদের বিকৃত মানসিকতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। কেননা, মতবিরোধ থাকা সত্তে¡ও বিভিন্ন ফিরকা এবং দল-উপদল যেভাবে বাংলাদেশে মুসলমান হিসাবে স্বীকৃত তেমনিভাবে আমরা, অর্থাৎ আহমদীয়া মুসলিম জামাতের সদস্যরাও মুসলমান হিসাবে পরিগণ্য। আমাদের কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’। আমরা ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভে বিশ্বাসী ও আমলকারী। একইভাবে আমরা ‘ঈমানে মুজমাল’ ও ‘ঈমানে মুফাস্সালে’ বর্ণিত সকল বিষয়ে ঈমান রাখি।
আহমদীয়া মুসলিম জামাতের পবিত্র প্রতিষ্ঠাতা হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) বলেছেন, “আমরা ঈমান রাখি, খোদা তা’লা ছাড়া কোন মাবুদ নাই এবং সৈয়্যদনা হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্র রসূল এবং খাতামুল আম্বিয়া। আমরা ঈমান রাখি, ফিরিশতা, হাশর, বিচার দিবস, জান্নাত ও জাহান্নাম সত্য এবং আমরা আরও ঈমান রাখি, কুরআন শরীফে আল্লাহ তা’লা যা বলেছেন এবং আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক যা বর্ণিত হয়েছে, উল্লিখিত বর্ণনানুসারে তা সবই সত্য। আমরা আরও ঈমান রাখি, যে ব্যক্তি এই ইসলামী শরীয়ত থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হয় অথবা যে বিষয়গুলো অবশ্যকরণীয় বলে নির্ধারিত তা পরিত্যাগ করে এবং অবৈধ বস্তুকে বৈধকরণের ভিত্তি স্থাপন করে, সে ব্যক্তি বেঈমান এবং ইসলামের গণ্ডিবহির্ভূত। আমি আমার জামা’তকে উপদেশ দিচ্ছি, তারা যেন বিশুদ্ধ অন্তরে পবিত্র কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-এর প্রতি ঈমান রাখে এবং এই ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করে। কুরআন শরীফ থেকে যাদের সত্যতা প্রমাণিত, এমন সকল নবী (আলাইহিমুস সালাম) এবং কিতাবের প্রতি ঈমান আনবে। নামায রোজা, হজ্জ ও যাকাত এবং এতদ্ব্যতীত খোদা তা’লা এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক নির্ধারিত কর্তব্যসমূহকে প্রকৃতপক্ষে অবশ্যকরণীয় মনে করে, যাবতীয় নিষিদ্ধ বিষয়কে নিষিদ্ধ জ্ঞান করে সঠিকভাবে ইসলাম ধর্ম পালন করবে। মোটকথা যে সমস্ত বিষয়ে আকিদা ও আমল হিসেবে পূর্ববর্তী বুযুর্গানের ইজমা তথা সর্ববাদি সম্মত মত ছিল এবং যে সমস্ত বিষয়কে আহলে সুন্নত জামা’তের সর্ববাদি সম্মত মতে ইসলাম নাম দেওয়া হয়েছে, তা সর্বতোভাবে মান্য করা অবশ্য কর্তব্য’ (আইয়ামুস সুলেহ, পুস্তক, পৃষ্ঠা ৮৭)
আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের সাথে অন্যান্য সাধারণ মুসলমানদের তফাৎ বা মতবিরোধ কেবল একটি ভবিষ্যদ্বাণীকে কেন্দ্র করে। আহমদীরা বিশ্বাস করে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী যথাসময়ে এসে গেছেন আর অন্যরা বিশ্বাস করে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী (আ.) এখনও আসেন নি, কিন্তু আসবেন। এখন পর্যন্ত আহমদীরা সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুসলমান হিসাবেই পরিগণ্য এবং আমরা নিজেদেরকে মুসলমান হিসাবেই বিশ্বাস করি। অতএব এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সরকারি গোরস্তানে বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের আহমদী মুসলমানের কবর হবে না একথা সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমাদের জন্য অবিশ্বাস্য! ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও গত ৯ জুলাই-এর বিকৃত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। কেননা, আস্তিক-নাস্তিক, মুসলমান-অমুসলমান সবার শেষ ঠাঁই খোদার সৃষ্ট এ মাটিতেই হয়। সমস্ত ধর্মীয় মতবিরোধ সত্তে¡ও আল্লাহ ‘রাব্বুল আলামীন’ জগতসমূহের একমাত্র প্রতিপালক হিসাবে সবাইকে সমভাবে লালনপালন করে থাকেন। বিশ্বাসের বিরোধ থাকা সত্তে¡ও সবাইকে একই মেঘের পানি দিয়ে তিনি সিঞ্চিত করেন। আস্তিক-নাস্তিক সবাইকে তাঁর সৃষ্ট সূর্য নিজের রোদ সমভাবে প্রদান করে। এই একই কাদামাটিতে সবাই চাষাবাদ করে সমানভাবে উপকৃত হয়। মহান আল্লাহর দয়া ও কৃপার এই সার্বজনিনতা মানুষকে, বিশেষ করে মুসলমানদেরকে শিক্ষা দিচ্ছে, আমরাও যেন খোদার গুণে গুণান্বিত হয়ে সবার জন্য উদারতা প্রদর্শন করি। উগ্র-ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর এহেন কর্মকাণ্ড মহানবী (সা.)-এর আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।
নবীজি (সা.) ঘোরতর শত্ত্রু ও কাফেরের লাশকেও সম্মান প্রদর্শন করতেন। একবার হযরত সাহল ইবনে হুনাইফ (রা.) ও কায়স ইবনে সা’দ (রা.) কাদ্সিয়াতে বসা ছিলেন, তখন লোকেরা তাঁদের সামনে দিয়ে একটি জানাযা নিয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে তাঁরা দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাঁদের বলা হল, এটা এ দেশীয় অমুসলিম জিম্মী ব্যক্তির জানাযা। তখন তাঁরা বললেন, ‘একবার নবী (সা.)-এর সামনে দিয়েও একটি জানাযা যাচ্ছিল। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলে তাঁকে বলা হয়েছিল, এটা তো এক ইহুদীর জানাযা। তিনি এরশাদ করেছিলেন, সে কি একজন মানুষ নয়? (বুখারী কিতাবুল জানায়েয, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনূদিত, হাদীস নম্বর ১২৩৪) অতএব, সাধারণ কোন লাশ বা কোন নিষ্পাপ শিশুর লাশ তো দূরের কথা এক ঘোরতর শত্রু কাফের ইহুদীর লাশের প্রতিও আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্মান প্রদর্শন করেছেন। শুধু তা-ই নয় তাঁর দীক্ষায় দীক্ষিত সাহাবীরাও একই আচরণ করে দেখিয়েছেন।
অতএব, ঘাটুরায় নিষ্পাপ শিশুর লাশের সাথে মুসলমান নামধারীরা যে বর্বর আচরণ করেছে তাদের এহেন কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্ট সাব্যস্ত হয় তারা আর যা-ই হোক মহানবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে না। তর্কচ্ছলে যদি একথা মেনেও নেয়া হয়, উগ্র-ধর্মান্ধদের দৃষ্টিতে যেহেতু আহমদীরা অমুসলমান তাই যেখানে তাদের অন্যায় দাপট রয়েছে সেখানে আহমদীদেরকে তারা মুসলমান মানতে নারাজ- সেক্ষেত্রেও গত ৯ জুলাই-এর বর্বরতা ও ধৃষ্টতা ধোপে টিকে না। কেননা, মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা এর বিপরীত সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবজাতক ফিতরতের ওপর জন্মগ্রহণ করে। এরপর তার মাতাপিতা তাকে ইয়াহুদী বা খ্রিস্টান অথবা অগ্নি-উপাসকরূপে রূপান্তরিত করে’ (সহীহ বুখারী, কিতাবুল জানায়েয, দ্বিতীয় খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনূদিত, হাদীস নম্বর-১৩০২)। ৭২ ঘণ্টার একটি শিশু যার ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত দেয়া হয়েছে তাকে কীভাবে কাফের বলা যেতে পারে? কেননা, মহানবী (সা.)-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নবজাতক শিশু পুণ্য ফিতরতে (তথা ইসলামে) জন্ম গ্রহণ করে থাকে। অতএব ৭২ ঘণ্টার নিষ্পাপ শিশুকে কোনমতেই সরকারি গোরস্তানে দাফন হবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না! মহানবী (সা.)-এর উম্মত হবার দাবীদার উগ্র-ধর্মান্ধরা মুখে মুসলমান ও মহানবী (সা.)-এর প্রকৃত অনুসারী হবার দাবী করলেও গত ৯ জুলাই-এর ঘটনা আবারও সাব্যস্ত করছে, মুখে তারা যা-ই বলুক বাস্তবে তারা মহানবী (সা.)-এর কথা মান্য করে না।
উল্লেখ্য, একই উগ্র-ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ১৯৮৭ সালে জোরপূর্বক আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের যে ৪টি মসজিদ (ঘাটুরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কান্দিপাড়া, আখাউড়া এবং ভাদুঘরে অবস্থিত) দখল করে নেয় সেগুলো এখনো এই উগ্র-ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর অবৈধ দখলে রয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন, “যে মসজিদের ভিত্তি তাকওয়ার ওপর রাখা হয়েছে কেবল সে মসজিদেই তুমি হে মুহাম্মদ (সা.) (নামাযের জন্য) দাঁড়াবে এছাড়া অন্য মসজিদে নয়।…” (সূরা তওবা, ১০৮)। অতএব, যারা আহমদীয়াদেরকে কাফের বলে আখ্যা দেয় তাদের মতে, আহমদীরা অমুসলিম বলে এসব মসজিদ সম্পূর্ণ তাকওয়া বিবর্জিত। সেক্ষেত্রে তারা সেখানে কীভাবে নামায আদায় করতে পারে? বুঝা যাচ্ছে, এদের ফতোয়া নিছক স্বার্থসিদ্ধির জন্য। পরিশেষে, আমরা আমাদের মৌলিক নাগরিক অধিকার হরণ করার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং এ ঘৃণ্য অপরাধের সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি। একইসাথে, যদি উগ্র-ধর্মান্ধদের চাপে আমাদেরকে সরকারি সাধারণ গোরস্তানে দাফন হবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় সেক্ষেত্রে আমাদের জন্য ভিন্ন সরকারি গোরস্তান বরাদ্দ করার দাবি জানাচ্ছি। সেইসাথে, উগ্র-ধর্মান্ধদের দ্বারা অবৈধভাবে দখলকৃত আহমদীয়া মসজিদগুলো আমাদেরকে ফিরিয়ে দেয়ারও দাবী জানাচ্ছি। এসব উগ্র-ধর্মান্ধদের এখনই প্রতিরোধ করা না হলে আমাদের দেশ ও সমাজ অদূর ভবিষ্যতে মহাসঙ্কটের সম্মুখিন হবে বলে আমরা আশঙ্কা করি।
শহিদুল ইসলাম, সাধারণ বিষয়ক সচিব , আহমদীয়া মুসলিম জামাত, বাংলাদেশ
Leave a Reply