December 25, 2024, 8:47 am
নিখিলবীশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বর্তমান ইমাম সৈয়্যদানা হযরত আমীরুল মুমিনীন খলীফাতুল মসীহ্ আল-খামেস (আই.) গত ২ অক্টোবর, ২০২০ ইসলামাবাদ, টিলফোর্ডের মসজিদে মোবারক থেকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় মহানবী (সা.)-এর বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের স্মৃতিচারণের ধারাবাহিকতায় হযরত আবু উবায়দা বিন জাররাহ্ (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করেন।
হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, বদরী সাহাবীদের স্মৃতিচারণের ধারাবাহিকতায় আজ যে সাহাবীর স্মৃতিচারণ করা হবে তিনি হলেন হযরত আবু উবায়দা বিন জাররাহ্। তার প্রকৃত নাম আমের বিন আব্দুল্লাহ্ ও তার পিতার নাম আব্দুল্লাহ্ বিন জাররাহ্; তবে তাকে তার দাদার নামের প্রতি আরোপ করেই ডাকা হতো এবং তিনি সেই ডাকনামেই অধিক পরিচিত। তার মাতার নাম উমায়মা বিনতে গানাম। তিনি কুরায়শদের বনু হারেস বিন ফেহর গোত্রের সদস্য ছিলেন। তিনি দীর্ঘকায় ও হালকা-পাতলা গড়নের লোক ছিলেন, মুখ কিছুটা শুকনো ছিল। তার সামনের দু’টি দাঁত উহুদের যুদ্ধে মহানবী (সা.) গালে ঢুকে যাওয়া শিরস্ত্রাণের আংটা বের করতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। তার দাঁড়ি কিছুটা পাতলা ছিল এবং তিনি কলপ ব্যবহার করতেন। হযরত আবু উবায়দা বেশ কয়েকটি বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু কেবল দু’জন স্ত্রীর ঘরে তার সন্তান ছিল। তার দু’পুত্রের নাম ইয়াযিদ ও উমায়ের।
তিনি ‘আশারায়ে মুবাশশারা’ অর্থাৎ সেই দশজন সৌভাগ্যবান সাহাবীর একজন ছিলেন, যাদেরকে মহানবী (সা.) তাদের জীবদ্দশাতেই জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন। তিনি কুরায়শদের মর্যাদাবান, সচ্চরিত্র ও লজ্জাশীল ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য হতেন। তিনি হযরত আবু বকরের তবলীগে ইসলাম গ্রহণ করেন; তিনি ইসলাম গ্রহণকারী নবম ব্যক্তি আর দারে আরকাম যুগের পূর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।মহানবী (সা.) বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক উম্মতের একজন ‘আমীন’ (অর্থাৎ বিশ্বস্ত ব্যক্তি) থাকেন, আর আমার উম্মতের আমীন আবু উবায়দা বিন জাররাহ্।’
নাজরান বা ইয়েমেন থেকে কিছু লোক এসে মহানবী (সা.)-এর কাছে তাদের সাথে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে পাঠাতে বলে, যিনি তাদেরকে ইসলাম শেখাবেন। তখন মহানবী (সা.) হযরত আবু উবায়দার হাত ধরে বলেন, “ইনি এই উম্মতের আমীন” এবং তার উপর এই দায়িত্ব অর্পণ করেন। মহানবী (সা.) একবার বলেন, “আবু বকর, উমর, আবু উবায়দা বিন জাররাহ্, উসায়েদ বিন হুযায়ের, সাবেত বিন কায়স বিন শামাস, মুআয বিন জাবাল, মুআয বিন আমর বিন জামূহ এরা কতই না উত্তম ব্যক্তি!”
একবার হযরত আয়েশা (রা.)-কে প্রশ্ন করা হয়, ‘যদি মহানবী (সা.) তাঁর পরে কাউকে নিজের স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করতেন, তবে কাকে করতেন?’ হযরত আয়েশা বলেন, ‘হযরত আবু বকরকে।’ তাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘এরপর কাকে?’ তিনি হযরত উমরের নাম বলেন। তখন তাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘এরপর কাকে?’ হযরত আয়েশা বলেন, ‘হযরত আবু উবায়দা বিন জাররাহ্কে।’ হযরত উমর (রা.)-ও তার মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন, “যদি আজ আবু উবায়দা জীবিত থাকতেন, তবে আমি পরবর্তী খলীফা হিসেবে তার নামই ঘোষণা করতাম; কেননা তিনি স্বয়ং মহানবী (সা.)-এরই ভাষ্য অনুসারে তাঁর (সা.) উম্মতের ‘আমীন’ ছিলেন।” হযরত আবু বকর (রা.)-ও তাকে খলীফা হওয়ার যোগ্য মনে করতেন। মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের অব্যবহিত পরে যখন আনসারদের পক্ষ থেকে খিলাফতের দাবী ওঠে, তখন হযরত আবু বকর (রা.) গিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন ও তাদের এই ভ্রান্তির অপনোদন করে বলেন যে আমীর কুরায়শদের মধ্য থেকে হবেন, আনসাররা হবেন মন্ত্রী। হযরত আবু বকর এ-ও বলেন, ‘উমর কিংবা আবু উবায়দা বিন জাররাহর মধ্য থেকে কোন একজনের হাতে তোমরা বয়আত করে নাও।’ তবে হযরত উমর তৎক্ষণাৎ বলেন, ‘না, আমরা তো আপনার হাতে বয়আত করব! কেননা আপনি আমাদের নেতা ও আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি, আর আমাদের মধ্য থেকে রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি।’ হযরত আবু উবায়দা যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তার পিতা তাকে অনেক অত্যাচার-নিপীড়ন করে।
তিনি আবিসিনিয়ায়ও হিজরত করেছিলেন। যখন তিনি হিজরত করে মদীনায় আসেন, তখন তাকে দেখে মহানবী (সা.) অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। হিজরতের পর হযরত আবু উবায়দা প্রথমে হযরত কুলসুম বিন হিদমের বাড়িতে ওঠেন। মহানবী (সা.) কার সাথে তার ভ্রাতৃত্ব-সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, তা নিয়ে একাধিক অভিমত রয়েছে। কারও কারও মতে হযরত আবু হুযায়ফার মুক্তকৃত ক্রীতদাস হযরত সালেমের সাথে মহানবী (সা.) তার ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছিলেন; কারও মতে হযরত মুহাম্মদ বিন মাসলামা ছিলেন তার ধর্মভাই এবং অপর কতকের মতে তার ধর্মভাই ছিলেন হযরত সা’দ বিন মুআয। হযরত আবু উবায়দা বদর, উহুদসহ অন্যান্য সকল যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশগ্রহণ করেন। বদরের যুদ্ধে তার পিতা আব্দুল্লাহ্ কাফেরদের পক্ষ থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তার বাবা তাকে আক্রমণের লক্ষ্য বানায়, কিন্তু আবু উবায়দা তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। হযরত আবু উবায়দা যদিও নিজের বাবাকে হত্যা করতে চাইছিলেন না, কিন্তু তারা বাবা তাকে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর ছিল। যখন আবু উবায়দা নিজ পিতার এই অবস্থা দেখলেন, তখন নিজ রক্তের প্রতি টানের বিপরীতে তার মাঝে আল্লাহ্র তওহীদের জন্য আত্মাভিমান জেগে ওঠে; তিনি তার বাবা আব্দুল্লাহ্কে হত্যা করতে বাধ্য হন। উহুদের যুদ্ধের দিন বিপর্যয়ের সময় যখন মুসলিম বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল, তখন যে স্বল্পসংখ্যক সাহাবী রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে দৃঢ়-অবিচল ছিলেন, তাদের মধ্যে আবু উবায়দা অন্যতম। উহুদের যুদ্ধের দিন ইবনে কামিয়া নামক এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে পাথর ছুঁড়ে মারে, যেটি তাঁর (সা.) মুখমণ্ডলে আঘাত করে এবং তাঁর (সা.) শিরস্ত্রাণের দু’টি আংটা ভেঙে গিয়ে তাঁর গালে গেঁথে যায়। রসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে আক্রান্ত হতে দেখে হযরত আবু উবায়দা এত দ্রুত ছুটে আসেন যে দূর থেকে দেখে হযরত আবু বকরের মনে হচ্ছিল তিনি যেন উড়ে যাচ্ছেন। হযরত আবু উবায়দা রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর গালে গেঁথে যাওয়া একটি আংটা নিজের দাঁতে কামড়ে ধরে সজোরে টান দেন; তিনি এত জোরে টান দেন যে টানের চোটে তার একটি দাঁত পড়ে যায় এবং তিনি মাটিতে গিয়ে পড়েন। একইভাবে তিনি অপর আংটাটিও বের করেন এবং তার আরও একটি দাঁত পড়ে যায়। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় সন্ধির চুক্তিপত্রে মুসলমানদের পক্ষ থেকে যেসব সাহাবী স্বাক্ষর করেছিলেন, তাদের মধ্যে হযরত আবু উবায়দাও অন্যতম। মহানবী (সা.) হযরত আবু উবায়দাকে একাধিক অভিযানে প্রেরণ করেন।
৭ম হিজরিতে মুহাম্মদ বিন মাসলামার নেতৃত্বে যুল-কাস্সায় যে দশজন সাহাবীকে খবর সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল, আক্রমণোদ্যত শত্রুদের সাথে তাদের লড়াই হয় এবং মুহাম্মদ বিন মাসলামা ব্যতীত সবাই শহীদ হন। মহানবী (সা.) হযরত মুহাম্মদ বিন মাসলামার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য হযরত আবু উবায়দার নেতৃত্বে চল্লিশজন সাহাবীকে প্রেরণ করেন এবং তারা শত্রুকে পরাজিত করে ফিরে আসেন। ৭ম বা ৮ম হিজরির ঘটনা; মহানবী (সা.) সংবাদ পান যে বনু কুযাআ গোত্রের লোকেরা মদীনায় আক্রমণের ষড়যন্ত্র করছে। রসূলুল্লাহ্ (সা.) হযরত আমর বিন আস-এর নেতৃত্বে তিনশ’ সাহাবী তাদের প্রতি প্রেরণ করেন। আমর বিন আ’স যখন দেখেন যে শত্রুরা সংখ্যায় অনেক বেশি, তখন আরও সৈন্য প্রেরণের আবেদন জানান। মহানবী (সা.) আবু উবায়দার নেতৃত্বে আরও দু’শ সাহাবী পাঠান এবং আবু উবায়দাকে আমর বিন আ’সের সাথে মিলে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেন ও বিভক্ত হতে নিষেধ করেন। আবু উবায়দার বাহিনী পৌঁছলে আমর (রা.) একাই পুরো বাহিনীর নেতৃত্ব নিতে চান; আবু উবায়দা তা মেনে নিয়ে তার অধীনেই অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন ও শত্রুদের পরাজিত করেন। মদীনা ফিরে এলে যখন রসূলুল্লাহ্ (সা.) সব বৃত্তান্ত শোনেন, তখন তার আনুগত্যে মুগ্ধ হয়ে দোয়া করেন: ‘আল্লাহ্ আবু উবায়দার উপর কৃপা করুন।’ সীফুল বাহর-এর অভিযানেও হযরত আবু উবায়দা তিনশ’ সাহাবীর দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এটি হুদাইবিয়ার সন্ধির পরের ঘটনা এবং এই বাহিনী কোন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে নয়, বরং একটি নিরাপত্তা চৌকি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রেরিত হয়েছিল; আর তা কুরায়শদের সিরিয়া-ফেরত কাফেলার নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রেরিত হয়েছিল। যেহেতু এমন আশংকা ছিল যে কুরায়শদের কাফেলা কোনভাবে আক্রান্ত হলে তারা মুসলমানদের উপর এর দায় চাপিয়ে সন্ধিচুক্তি অস্বীকার করতে পারে, সেজন্য মহানবী (সা.) শত্রুদের নিরাপত্তা বিধানে এই ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
সাহাবীরা ‘সীফুল বাহর’ বা সমুদ্র-তীরবর্তী পথে প্রহরা দিয়েছিলেন। সাহাবীদের খাদ্যের এতটা সংকট ছিল যে ক্ষুধার তাড়নায় তারা গাছের পাতাও খেতেন। আল্লাহ্ তা’লা সাহাবীদের খাদ্য-সংকট দূর করার ব্যবস্থা করেন; সমুদ্র থেকে একটি মৃত তিমি তীরে এসে পড়ে। হযরত আবু উবায়দার নির্দেশে সাহাবীরা এর মাংস খান এবং তা দিয়ে অনেক দিন চলে যায়। অভিযান শেষে মদীনায় ফিরে সাহাবীরা যখন এই তিমি-বৃত্তান্ত মহানবী (সা.)-কে শোনান, তখন তিনি (সা.) এটি খাওয়া অনুমোদন করেন এবং নিজেও তাদের কাছ থেকে এক টুকরো মাংস নিয়ে খান।হযরত আবু বকর (রা.) খিলাফতে সমাসীন হওয়ার পর হযরত আবু উবায়দাকে বায়তুল মালের তত্তাবধায়ক নিযুক্ত করেন; ১৩শ হিজরিতে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যখন মুসলিম বাহিনী প্রেরিত হয়, তখন এর নেতৃত্ব তার উপর অর্পণ করেন। হযরত উমর (রা.) খিলাফতে সমাসীন হওয়ার পর হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদকে সেনাপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দান করে হযরত আবু উবায়দাকে দায়িত্ব দেন। সিরিয়া-বিজয়ে হযরত আবু উবায়দা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি প্রথমে মোয়াব শহর জয় করেন। আজনাদায়ন-এর যুদ্ধে রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের ভাই থিওডরের নেতৃত্বাধীন এক লক্ষ সৈন্যের বিরুদ্ধে মুসলমানরা ৩৫ হাজার সৈন্য নিয়েও জয়ী হন। একে একে জর্ডান, হোমস, লাতাকিয়া প্রভৃতি শহর জয় করে অবশেষে সিরিয়া বিজিত হয়। হুযূর (আই.) এর নাতিদীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরেন। হুযূর (আই.) বলেন যে হযরত আবু উবায়দার স্মৃতিচারণ পরবর্তীতেও অব্যাহত থাকবে, ইনশাআল্লাহ্।
খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) পাকিস্তানের আহমদীদের জন্য বিশেষভাবে দোয়ার তাহরিক করেন যে আল্লাহ্ তা’লা যেন তাদেরকে মৌলভীদের ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ রাখেন। সেখানে আবারও বিরোধিতা প্রবল আকার ধারণ করেছে। হুযূর বলেন, পাকিস্তানে আইনের রক্ষকরা ন্যায়ের পক্ষে কাজ করার পরিবর্তে ন্যায়-নীতির বারোটা বাজাচ্ছে এবং মৌলভীরা যা বলছে, তারা তা-ই করছে।
হয়তো তারা ভাবছে যে এভাবে তাদের গদি রক্ষা পাবে, কিন্তু এটা তাদের ভয়ংকর ভুল; আসলে এটিই তাদের ধ্বংসের কারণ হবে। হুযূর আহমদীদেরকে অনেক বেশি দোয়া করতে বলেন, যেন আল্লাহ্ তা’লা এই বিপদ দূরীভূত করেন, একইসাথে আমাদেরকে আল্লাহ্ তা’লার সাথেও নিজেদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার উপদেশ প্রদান করেন। আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে যেন দ্রুত সাহায্য সমাগত হয় এবং সেদেশে বসবাসকারী আহমদীরা যেন এই বিপদ থেকে মুক্তি লাভ করেন। (আমীন)
[হুযূরের খুতবা সরাসরি ও সম্পূর্ণ শোনার কখনোই কোন বিকল্প নেই]
Leave a Reply