December 14, 2024, 3:25 am
নিখিলবিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম সৈয়্যদনা হযরত আমীরুল মুমিনীন খলীফাতুল মসীহ্ আল-খামেস (আই.) গত ৯ অক্টোবর, ২০২০ ইসলামাবাদ, টিলফোর্ডের মসজিদে মোবারক থেকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় বিগত খুতবার ধারাবাহিকতায় মহানবী (সা.)-এর বদরী সাহাবী হযরত আবু উবায়দা_বিন_জাররাহ্ (রা.)-এর অবশিষ্ট স্মৃতিচারণ করেন।
হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, বিগত খুতবায় হযরত আবু উবায়দার স্মৃতিচারণ করা হচ্ছিল, আজ তার অবশিষ্টাংশ বর্ণনা করা হবে। ১৫ হিজরিতে ইয়ারমূকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইয়ারমূক সিরিয়ার উপকণ্ঠে অবস্থিত একটি উপত্যকার নাম, এখানেই ইয়ারমূক নদীর তীরে সেই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রোমানরা বিখ্যাত সেনাপতি বাহানের নেতৃত্বে প্রায় আড়াই লাখ সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে এসেছিল। অপর দিকে মুসলিম-বাহিনীর সংখ্যা ছিল মাত্র ত্রিশ হাজারের মত; তাদের মধ্যে একশ’জন বদরী সাহাবীসহ এক হাজার সাহাবী ছিলেন। অনেক পরামর্শের পর মুসলিম বাহিনী কৌশলগত কারণে সাময়িকভাবে হোমস থেকে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়। হোমস ছাড়ার আগে মুসলমানরা এই বলে সেখানকার খ্রিস্টান বাসিন্দাদেরকে তাদের কাছ থেকে নেয়া জিযিয়া ফেরত দেয় যে ‘যেহেতু আমরা সাময়িকভাবে তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিচ্ছি, তাই এটি ফেরত দিচ্ছি’।
মুসলমানদের এই মহানুভবতা দেখে খ্রিস্টানরা কেঁদে কেঁদে বলে, ‘হে দয়ালু মুসলমান শাসকগণ, খোদা আবারও তোমাদেরকে ফিরিয়ে আনুন!’ হোমস পুনরায় কব্জায় নিতে পেরে রোমানদের উৎসাহ আরও বেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু একইসাথে তারা মুসলমানদের ঈমানী শক্তিকে ভয়ও পাচ্ছিল। তাই তারা সন্ধি করার চেষ্টা করে। বাহান তার একজন দূত পাঠায়, যার নাম ছিল জর্জ। জর্জ মাগরিবের সময় দেখা করতে আসে এবং নামাযে মুসলমানদের বিনয় ও আবেগ দেখে খুবই প্রভাবিত হয়। সে হযরত আবু উবায়দার কাছে ঈসা (আ.) সম্পর্কে প্রশ্ন করে যে তার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী? তিনি তখন সূরা নিসার ১৭২ ও ১৭৩নং আয়াত তাকে শোনান যেখানে আল্লাহ্ তা’লা হযরত ঈসা (আ.)-কে তাঁর একজন রসূল বলে উল্লেখ করেছেন এবং খ্রিস্টানদেরকে ত্রিত্ববাদ থেকে বিরত হতে বলেছেন। কুরআন শরীফের এই শিক্ষা শুনে জর্জ এর সাথে ঐক্যমত প্রকাশ করে এবং মুসলমান হয়ে যায়। সে আর রোমানদের কাছে ফিরে যেতে চাইছিল না, কিন্তু হযরত আবু উবায়দা তাকে এজন্য ফিরে যেতে বলেন যে সে ফিরে না গেলে রোমানরা তাকে বিশ্বাসঘাতক মনে করবে।
পরদিন যে মুসলমান দূত রোমানদের কাছে যাবে, তার সাথে তিনি তাকে ফিরে আসতে বলেন। হযরত আবু উবায়দা ও হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ পরপর দু’দিন দু’জন গিয়ে রোমানদের ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান, কিন্তু তারা তাতে সাড়া না দেয়ায় যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। হযরত আবু উবায়দা তার অসাধারণ ভাষণে মুসলিম-বাহিনীকে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করেন। রোমানরা সংখ্যায় মুসলমানদের চেয়ে বহুগুণে বেশি ছিল এবং তারা এতটা বদ্ধ-পরিকর ছিল যে নিজেদের পা একসাথে শেকলে বেঁধে নেমেছিল যে তারা কোনভাবেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাবে না। প্রথমদিকে তারা মুসলমান বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলে; তাদের তীরন্দাজরা দূর থেকে বেছে বেছে সাহাবীদেরকে হত্যা করতে থাকে যেন মুসলমানদের মনোবল ভেঙে পড়ে। এই অবস্থা দেখে ইকরামা, যিনি মক্কা-বিজয়ের দিন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং মহানবী (সা.)-এর কাছে দোয়ার আবেদন করেছিলেন যে আল্লাহ্ তা’লা যেন তাকে তার পূর্বকৃত কর্মকাণ্ডের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার সামর্থ্য দান করেন, তিনি হযরত আবু উবায়দার কাছে গিয়ে নিবেদন করেন, ‘সাহাবীরা তো অনেক করেছেন! আজ আমরা যারা যুবক, যারা পরে ইসলাম গ্রহণ করেছি আমাদেরকে পুণ্য অর্জনের সুযোগ দিন। আমরা একদল গিয়ে একেবারে রোমান বাহিনীর কেন্দ্রে আঘাত হানব আর তাদের সেনাপতিদের হত্যা করব।’
হযরত আবু উবায়দা এই অনুমতি দিতে চাচ্ছিলেন না; কারণ এভাবে যারা আক্রমণ করবে, তারা তো সবাই মারা পড়বে! তখন ইকরামা বলেন, ‘আপনি কি চান যে সাহাবীরা মৃত্যুবরণ করুন আর আমরা যুবকরা বেঁচে থাকি?’ অবশেষে তার বারংবার অনুরোধের প্রেক্ষিতে আবু উবায়দা তাকে অনুমতি দেন। ইকরামা চারশ’ যুবককে নিয়ে রোমান বাহিনী কেন্দ্রে আঘাত হানেন এবং যেমনটি বলেছিলেন, তেমনটি করেন। এর ফলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়; রোমানরা পিছু হটতে শুরু করে। পিছু হটতে গিয়ে তারা নিজেদেরই খোঁড়া পরিখায় গিয়ে পড়তে থাকে; শেকলে বাঁধা থাকায় একজন পড়লেই সাথে আরও দশজনকে নিয়ে পড়ছিল। ফলাফল এই দাঁড়ায় যে আশি হাজার রোমান সৈন্য ইয়ারমূক নদীতে ডুবে মারা যায় ও এক লক্ষ যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। এই যুদ্ধে তিন হাজার মুসলমান শহীদ হন; ইকরামাসহ তার দলের প্রত্যেকেই শাহাদাতবরণ করেন। নিজের অন্তিম মুহূর্তেও নিজে পানি পান না করে তা প্রথম যুগের সাহাবীদের জন্য উৎসর্গ করে ইকরামা অসাধারণ আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করেন।সিরিয়ায় বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও বর্ণের লোকের বসবাস ছিল।
হযরত আবু উবায়দা সিরিয়া জয়ের পর তাদের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করেন, সকলকে ধর্মীয় স্বাধীনতা দান করেন। ইসলামের এই মহত্ব দেখে সবাই স্বেচ্ছায় ও সানন্দে ইসলাম গ্রহণ করে। এই যুদ্ধের শেষদিকেই হযরত আবু বকর মৃত্যুবরণ করেন এবং হযরত উমর খলীফা হন। হযরত উমর খিলাফতে সমাসীন হওয়ার সাথে সাথেই পত্র পাঠিয়ে হযরত খালিদের স্থলে হযরত আবু উবায়দাকে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করেন; কিন্তু আবু উবায়দা তা প্রকাশ করেন নি। যুদ্ধ শেষে হযরত খালিদ যখন তা জানতে পারেন, তখন তিনি আশ্চর্য হয়ে এর কারণ জানতে চান; আবু উবায়দা বলেন যে শত্রুর সাথে যুদ্ধের চরম অবস্থায় তিনি চান নি যে হযরত খালিদ কোনভাবে মনক্ষুণ্ন হন। হযরত খালিদ নিজ বাহিনী নিয়ে ইরাক ফিরে যাওয়ার সময় মুসলিম বাহিনীকে বলেন, ‘তোমাদের আনন্দিত হওয়া উচিত যে তোমাদের নেতৃত্বে আছেন এই উম্মতের আমীন।’ তখন আবু উবায়দাও মহানবী (সা.)-এর বাণী উদ্ধৃত করে বলেন যে খালিদ বিন ওয়ালিদ আল্লাহর তরবারিগুলোর মধ্যে অন্যতম। মুসলমান নেতারা এমনটিই ছিলেন; কোনরূপ নেতৃত্ব বা কর্তৃত্বের লোভ তাদের ছিল না; কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই তাদের লক্ষ্য ছিল।সিরিয়া উদ্ধারে ১৭ হিজরিতে করা রোমানদের শেষ প্রচেষ্টাও হযরত আবু উবায়দার নেতৃত্বাধীন বাহিনীর কারণে বিফল হয় এবং তারা সিরিয়া উদ্ধারের সব আশা বিসর্জন দেয়। বায়তুল মুকাদ্দাস জয়েও হযরত আবু উবায়দার অসামান্য ভূমিকা ছিল। খ্রিস্টানরা শর্ত দিয়েছিল, মুসলমানদের খলীফা যদি নিজে আসেন, তাহলে তারা সন্ধি করে নেবে। এটি শুনে হযরত উমর মদীনায় হযরত আলীকে আমীর নিযুক্ত করে রওয়ানা হন। জাভিয়াতে মুসলিম-বাহিনী তাকে স্বাগত জানায়। তিনি সবার আগে আবু উবায়দার খোঁজ করেন। আবু উবায়দার ঘরে গিয়ে তিনি দেখেন, তার ঘরটিতে ঢাল-তলোয়ার ছাড়া কেবল একটি চাটাই এবং একটি পেয়ালা রয়েছে, আর কোন আসবাবপত্র নেই। তিনি আবু উবায়দাকে ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য হলেও এক-দুটো আসবাবপত্র রাখতে বলেন। জবাবে আবু উবায়দা বলেন, স্বাচ্ছন্দ্যের আয়োজন করতে গেলে সেটির আকর্ষণেই যে জীবন শেষ হয়ে যাবে, তাই তিনি এরূপ করতে অস্বীকৃতি জানান। হযরত আবু উবায়দার বাহিনীর সাথে যখন হযরত উমরের সাক্ষাৎ হয়, তখন তারা খলীফাকে অবগত করেন যে সিরিয়ায় প্লেগের মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে।
হযরত উমর প্রথমে মুহাজির, তারপর আনসার ও সবশেষে বয়োঃবৃদ্ধ কুরায়শদের সাথে পরামর্শ করে সাহাবীদের নিরাপত্তার স্বার্থে মদীনায় ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তখন হযরত আবু উবায়দা তখন প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আল্লাহ্ নিয়তিতে যা রেখেছেন, তাত্থেকে কি পালানো সম্ভব?’ হযরত উমর তখন হযরত আবু উবায়দাকে বলেছিলেন যে এটি নিয়তি থেকে পলায়ন নয়; বরং আল্লাহর এক তকদীর থেকে আল্লাহর অন্য তকদীরের দিকে যাওয়া। খানিক পরেই হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ এসে এ বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর বাণীও সকলকে অবগত করেন।
রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নির্দেশ হল কোন স্থানে যদি মহামারী ছড়িয়ে পড়ে, তবে সেখানে না যাওয়া; আর নিজ শহরেই যদি মহামারী হয়, তবে সেখান থেকে বাইরে না যাওয়া। হযরত উমর মদীনায় ফেরত আসার পরও প্লেগের কারণে মুসলিম-বাহিনীর নিরাপত্তা নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। তিনি হযরত আবু উবায়দাকে চিঠি লিখে দ্রুত মদীনায় চলে আসতে বলেন। হযরত আবু উবায়দা বুঝতে পারেন যে খলীফা তাকে প্লেগ থেকে বাঁচাতে চাইছেন, কিন্তু তিনি বিনয়ের সাথে নিজের বাহিনী ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। যখনই কোন মুসলমান সৈনিক প্লেগে শাহাদাতবরণ করতেন, হযরত আবু উবায়দা কেঁদে নিজের জন্যও শাহাদাত প্রার্থনা করতেন। অবশেষে তিনি ১৮ হিজরিতে ৫৮ বছর বয়সে প্লেগে শাহাদাতবরণ করেন ও জর্ডানে সমাহিত হন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি খলীফার কাছে তার সালাম পৌঁছাতে বলে যান এবং হযরত মুআয বিন জাবালকে নিজের স্থলাভিষিক্ত নির্বাচন করে যান।
খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) সম্প্রতি প্রয়াত কয়েকজন নিষ্ঠাবান আহমদীর গায়েবানা জানাযার ঘোষণা দেন। প্রথম জানাযা পেশোয়ার নিবাসী শহীদ প্রফেসর ড. নাঈম উদ্দীন খটক সাহেবের, যাকে গত ১৫ অক্টোবর দুপুর দেড়টার দিকে কলেজ থেকে ফেরার পথে দু’জন মোটরসাইকেলারোহী দুর্বৃত্ত গুলি করে শহীদ করে;
দ্বিতীয় জানাযা জার্মানি জামেয়ার তৃতীয় বর্ষের ছাত্র উসামা সাদেক সাহেবের, যিনি কিছুদিন পূর্বে জার্মানির রাইন নদীতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন;
তৃতীয় জানাযা জামেয়া ইউকে-র ইংরেজি ও ইতিহাসের শিক্ষক মোকাররম সলিম আহমদ মালেক সাহেবের, যিনি গত ২৪ সেপ্টম্বর ৮৭ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। হুযূর (আই.) মরহুমদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণে তাদের অসাধারণ গুণাবলী ও বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের কিছু ঝলক তুলে ধরেন এবং তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন। (আমীন)
[ হুযূরের খুতবা সরাসরি ও সম্পূর্ণ শোনার কখনোই কোন বিকল্প নেই ]
Leave a Reply