December 25, 2024, 8:47 am
বদরী সাহাবীদের (রা.) ধারাবাহিক পবিত্রময় স্মৃতিচারণে আজ হযরত বিলাল (রা.)-এর পবিত্রময় স্মৃতিচারণ:
নিখিলবিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের প্রাণপ্রিয় ইমাম সৈয়্যদানা হযরত আমীরুল মুমিনীন খলীফাতুল মসীহ্ আল-খামেস (আই.) গত ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ইসলামাবাদ, টিলফোর্ডের মসজিদে মোবারক থেকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় মহানবী (সা.)-এর বদরী সাহাবীদের স্মৃতিচারণের ধারাবাহিকতায় #হযরত_বিলাল_(রা.)-এর স্মৃতিচারণ করেন।
হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, আজ আমি যে বদরী সাহাবীর স্মৃতিচারণ করব তার নাম হল হযরত বিলাল বিন রাবাহ্ (রা.)। হযরত বিলালের পিতার নাম ছিল রাবাহ্ এবং মাতার নাম হামামাহ্; হযরত বিলাল উমাইয়া বিন খালাফের ক্রীতদাস ছিলেন। তার ডাকনাম ছিল আবু আব্দুল্লাহ্; অপর কতক বর্ণনায় আবু আব্দুর রহমান, আবু আমর ইত্যাদি নামেরও উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। তার মাতা আবিসিনিয়ান ছিলেন, কিন্তু পিতা আরবেরই বাসিন্দা ছিলেন।
গবেষকদের মতে তিনি সেমিটিক আবিসিনিয়ান ছিলেন, অর্থাৎ প্রাচীনকালে তাদের পূর্বপুরুষরা আরব থেকে আফ্রিকায় গিয়ে বসবাস শুরু করে; এর ফলে তাদের বর্ণ তো অন্যান্য আফ্রিকানদের মত হয়ে যায়, কিন্তু স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যে তারা আফ্রিকানদের মত ছিল না। পরবর্তীতে তাদের কতককে দাস বানিয়ে আরব নিয়ে আসা হয়; তাদের গায়ের রং যেহেতু কাল ছিল, তাই আরবরা তাদেরকে আবিসিনিয়ান বলত। এক বর্ণনামতে হযরত বিলাল মক্কাতেই জন্মগ্রহণ করেন; আরেক বর্ণনামতে তিনি সুরাহ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন যা ইয়েমেন ও আবিসিনিয়ার নিকটবর্তী একটি স্থান, যেখানে প্রচুর মিশ্র-জাতির লোকের বাস ছিল। হযরত বিলালের গায়ের রং ছিল গাঢ় বা কালচে বাদামী; তিনি ছিপছিপে গড়নের ছিলেন, মাথার চুল ঘন ও গাল দু’টো বসা ছিল। তিনি একাধিক বিবাহ করেছিলেন, তার স্ত্রীদের কেউ কেউ আরবের অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত বংশের নারী ছিলেন; হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফের বোন হালাহ বিনতে অওফ তার অন্যতম সহধর্মিনী ছিলেন। হযরত বিলাল নিঃসন্তান ছিলেন; খালেদ নামে তার একজন ভাই এবং গুফায়রা নামে একজন বোন ছিল।
হযরত বিলাল আবিসিনিয়ানদের মধ্যে প্রথম মুসলমান ছিলেন। মহানবী (সা.) বলতেন, ‘মুসলমানদের মধ্যে চারজন ব্যক্তি প্রথম; আরবদের মধ্যে প্রথম হলাম আমি, সালমান পারস্যবাসীদের মধ্যে প্রথম, বিলাল আবিসিনিয়ানদের মধ্যে প্রথম, সুহায়েব রোমানদের মধ্যে প্রথম।’ উরওয়া বিন যুবায়ের বর্ণনা করেন, হযরত বিলাল সেসব লোকের অন্যতম ছিলেন যাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করার পর চরম অত্যাচার করা হয়, যেন তারা এই ধর্ম পরিত্যাগ করেন; কিন্তু অত্যাচারীরা কখনোই তাকে দিয়ে সেসব কথা বলাতে পারে নি যা তারা চাইত। উমাইয়া বিন খালাফ তাকে অবর্ণনীয় অত্যাচার করত; মরুভূমির তপ্ত বালুর উপর শুইয়ে দিয়ে বুকের উপর পাথর চাপিয়ে দিত, কখনওবা এই অবস্থায় ছেলে-ছোকরারা তার উপর জুতো পরে লাফাতো, কখনও তার গলায় দড়ি বেঁধে পাথুরে মাটির উপর দিয়ে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যেত; কিন্তু তিনি সবসময় ‘আহাদ-আহাদ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ্ এক- আল্লাহ্ এক’ বলতে থাকতেন।
এভাবে একদিন যখন তার উপর প্রচণ্ড অত্যাচার করা হচ্ছিল, তখন হযরত আবু বকর ৭ অওকিয়া বা স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তাকে ক্রয় করে নেন। হযরত আবু বকর যখন তাকে কিনে নেন তখন হযরত বেলাল পাথরের স্তুপের তলে মৃতবৎ অবস্থায় পড়ে ছিলেন; কাফেররা আবু বকরকে বলেছিল, ‘তুমি চাইলে তো একে এক স্বর্ণমুদ্রা দিয়েই কিনতে পারতে!’ জবাবে হযরত আবু বকর বলেছিলেন, ‘তোমরা যদি একশ’ স্বর্ণমুদ্রাও চাইতে, তবে আমি তা দিয়েই তাকে কিনে নিতে প্রস্তুত ছিলাম!’ যখন তিনি মহানবী (সা.)-কে এটি জানান তখন হুযূর (সা.) বলেন, ‘হে আবু বকর, আমাকেও এতে অংশীদার কর।’ হযরত আবু বকর বলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল, আমি তো তাকে মুক্ত করে দিয়েছি! এটি শুনে হুযূর (সা.) খুবই আনন্দিত হন। হযরত উমর (রা.) বলতেন, ‘আবু বকর আমাদের নেতা; আর তিনি আমাদের নেতা বিলালকে মুক্ত করেছিলেন।’
হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ বর্ণনা করেন, সর্বপ্রথম সাতজন ব্যক্তি নিজেদের ইসলামগ্রহণের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন; রসূলুল্লাহ্ (সা.) স্বয়ং, হযরত আবু বকর, হযরত আম্মার ও তার মা হযরত সুমাইয়া, হযরত সুহায়েব, হযরত বিলাল ও হযরত মিকদাদ। রসূলুল্লাহ্ (সা.) ও হযরত আবু বকর তো স্বাধীন ব্যক্তি ছিলেন, তা সত্ত্বেও তাদেরকে ভয়াবহ অত্যাচার সইতে হয়েছে; আর বাকি পাঁচজন ক্রীতদাস হওয়ায় মুশরিকরা তাদের উপর চড়াও হয় এবং অবর্ণনীয় অত্যাচার চালায়। আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ বলেন, তাদের মধ্যে একজন ছাড়া সকলেই অত্যাচারের কোন এক পর্যায়ে মুশরিকদের কথায় সায় দিয়ে ফেলেছিলেন; আর সেই একজন হলেন হযরত বিলাল, যাকে দিয়ে কখনোই কোন অসঙ্গত কথা তারা বলাতে পারে নি। কাফেরদের প্রচণ্ড অত্যাচারের ফলে হযরত বিলাল ‘শিন’ বর্ণটি আর উচ্চারণ করতে পারতেন না, এটিকে ‘সিন’ উচ্চারণ করতেন। মদীনায় যখন মুসলমানরা কিছুটা স্বাধীনভাবে ইবাদত পালনে সমর্থ হয়, তখন মহানবী (সা.) হযরত বিলালকে আযান দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করেন।
তিনি ‘আশহাদু’র পরিবর্তে ‘আসহাদু’ উচ্চারণ করতেন, যা শুনে মদীনার লোকজন হাসাহাসি করত, যারা তার এই অতীত জানত না। মহানবী (সা.) একদিন তাদেরকে হাসাহাসি করতে দেখে বলেন, ‘তোমরা বিলালের আযান শুনে হাসছ? অথচ আল্লাহ্ তা’লা আরশ থেকে তার আযান শুনে খুশি হন!’ তিনি (সা.) বোঝাতে চেয়েছিলেন, আযানের উচ্চারণে কি-ইবা আসে যায়, আসল ব্যাপার তো হল আল্লাহর একত্ববাদের জন্য তার আত্মত্যাগ; তার কুরবানির কারণে আল্লাহ্ তা’লা তার ভুল উচ্চারণের আযান শুনেও আনন্দিত হন। হযরত বিলাল ‘আসসাবেকুনাল আওয়ালুন’দের মধ্যে পরিগণিত হতেন। মহানবী (সা.) বলতেন, ‘আমার উপর প্রথম ঈমান এনেছিল একজন দাস ও একজন স্বাধীন ব্যক্তি’; কারও কারও মতে এই দাস ছিলেন হযরত বিলাল, কারও মতে তিনি ছিলেন হযরত খাব্বাব; আর স্বাধীন ব্যক্তি যে হযরত আবু বকর ছিলেন তা তো সকলেরই জানা।
হযরত বিলাল হিজরতের পর মদীনায় এসে প্রথমে হযরত সা’দ বিন খায়সামার ঘরে ওঠেন।
মহানবী (সা.) হযরত উবায়দা বিন হারেসের সাথে তার ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন; অপর এক বর্ণনামতে তার ধর্মভাই ছিলেন হযরত আবু রুওয়াইহা খাসামি। মদীনায় হিজরত করে আসার পর অনেক সাহাবীই অসুস্থ হয়ে পড়েন; তারা জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতেন। হযরত বিলাল অত্যন্ত করুণ সুরে কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং জন্মভূমি মক্কার জন্য কাঁদতেন; আরও কয়েকজন সাহাবীও এরূপ করতেন। মহানবী (সা.) তাদের এই অবস্থা দেখে তাদের মনে মদীনার প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন এবং মদীনার অসুখ-বিসুখ দূর করে এর আবহাওয়া স্বাস্থ্যকর বানিয়ে দেয়ার দোয়া করেন; বস্তুতঃ তাঁর (সা.) দোয়া আল্লাহ্ কবুল করেন।
হযরত বিলাল বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশগ্রহণ করেছেন; বদরের যুদ্ধে তিনি উমাইয়া বিন খালাফকে হত্যা করেন, যে ইসলামের অনেক বড় শত্রু ছিল। হযরত বিলাল মহানবী (সা.)-এর ব্যক্তিগত সচিবের মত ছিলেন এবং তাঁর (সা.) কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মুয়াজ্জিনও ছিলেন; তিনি-ই সেই প্রথম ব্যক্তি যিনি আযান দেন। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর (আই.) আযানের ইতিহাসও তুলে ধরেন যে কিভাবে হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন যায়েদকে স্বপ্নে আযানের বাক্যগুলো শেখানো হয়েছিল এবং হযরত উমর (রা.)-ও একই স্বপ্ন দেখেছেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন; ফজরের আযানের ‘আসসালাতু খাইরুম্ মিনান্নাওম’ বাক্যটি হযরত বিলালের আবিষ্কৃত যা রসূলুল্লাহ্ (সা.) তাকে ফজরের আযানে যুক্ত করতে নির্দেশ দেন। হুযূর (আই.) বলেন, হযরত বিলালের স্মৃতিচারণ কিছুটা বাকি রয়েছে যা পরবর্তীতে করা হবে, (ইনশাআল্লাহ্)।
সাহাবীর স্মৃতিচারণ শেষে হুযূর কয়েকটি গায়েবানা জানাযার ঘোষণা দেন। প্রথম জানাযা বেলজিয়াম-প্রবাসী বাঙ্গালি রউফ বিন মাকসুদের, যে জামেয়া আহমদীয়া যুক্তরাজ্যের ছাত্র ছিল; গত ৪ সেপ্টেম্বর মাত্র ১৮ বছর বয়সে পরম করুণাময় আল্লাহর সান্নিধ্যে যাত্রা করে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মরহুম ২০১৮-তে জামেয়ায় ভর্তি হয়েছিল। হুযূর বলেন, স্নেহের রউফ তার নিষ্ঠা, সৃষ্টিসেবার স্পৃহা ও পরিশ্রমী বৈশিষ্ট্যের কারণে ছাত্র-শিক্ষক সকলের প্রিয়পাত্র ছিল; ছয়-সাত মাস পূর্বে তার ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে, পরম ধৈর্যের সাথে সে সব কষ্ট সহ্য করেছে।
মরহুমের বাবা হুমায়ূন মাকসুদ সাহেব ও মা মুহসেনা বেগম সাহেবা ছাড়াও তিন ভাই ও দু’বোন রেখে গিয়েছে। বেলজিয়ামের মুরব্বী সাহেব লিখেছেন, করোনা মহামারীর শুরুর দিকে তিনি রউফকে অনলাইনে আতফালদের ক্লাস নিতে বলেন; এর মধ্যেই তার অসুস্থতা শুরু হয়। কিন্তু রউফ অসুস্থ অবস্থাতেও হাসপাতাল থেকেই অনলাইনে ক্লাস নিত। তার অসুখের ভয়াবহতা বিবেচনা করে যখন তাকে অব্যাহতি নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়, তখন সে বলেছিল, ‘যখন করোনার পর জামেয়া খুলবে, তখন আমি গিয়ে হুযূরকে কী জবাব দেব যে ছুটির মধ্যে আমি জামাতের কী সেবা করেছি?’
হুযূর বলেন, সে জামেয়া পাস করার আগেই উত্তম মুরব্বী ও মোবাল্লেগ হয়ে গিয়েছিল। তার সম্পর্কে অনেকেই অসংখ্য স্মৃতিচারণ করেছেন, যেগুলো থেকে জামাত ও খিলাফতের প্রতি তার গভীর ভালবাসা ও নিষ্ঠা, ধর্মের সেবার প্রবল আগ্রহ এবং মহান আল্লাহর ইবাদতের প্রতি গভীর মনোযোগ ও নিমগ্নতা; ছোট-বড়, বন্ধু-বান্ধব, চেনা-অচেনা সকলের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার অসাধারণ চিত্র ফুটে ওঠে। হুযূর বলেন, আল্লাহ্ তা’লাই নিজের সিদ্ধান্তের প্রজ্ঞা ও রহস্য ভাল জানেন; অনেক সময় তিনি সবচেয়ে উত্তম বান্দাদের দ্রুত নিজের কাছে ডেকে নেন। হুযূর (আই.) তার রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং দোয়া করেন, আল্লাহ্ যেন তার নিকটজনদের ধৈর্য দান করেন।
দ্বিতীয় জানাযা ইসলামাবাদের সাবেক জেলা নায়েবে আমীর জাফর ইকবাল কুরাইশি সাহেবের।
তৃতীয় জানাযা সেনেগালের সাবেক সংসদ-সদস্য মোহতরম কাবিনে-কাবাজাকাটে সাহেবের ও চতুর্থ জানাযা লাহোরের মোকাররম ব্যারিস্টার মোবাশ্বের লতিফ সাহেবের; হুযূর তাদেরও সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন ও তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেন। (আমীন)
[হুযূরের খুতবা সরাসরি ও সম্পূর্ণ শোনার কখনোই কোন বিকল্প নেই]
Leave a Reply