November 18, 2024, 2:04 pm
ইসলামের নব জীবন ও এর বিশ্বব্যাপী প্রতিশ্রুত বিজয়ের লক্ষ্যে একটি মহান ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনের নাম আহ্মদীয়াত। এটা কোন নতুন ধর্ম নয়। ইসলামেরই অপর নাম আহ্মদীয়াত। রাজনীতির সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। কোন রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় এর সৃষ্টি হয়নি বা কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য দৃষ্টিপটে রেখে এর জন্মও হয়নি। কেবল মাত্র আল্লাহ্ তা’আলার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এবং তাঁর সম্মতি ও সমর্থন আর পৃষ্ঠপোষকতায় এ জামা’ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ইসলামের কলেমাই এর কলেমা। কলেমা “লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্”– এর ধারক ও বাহক হলেন এ জামাতের সদস্যরা। এরা আহ্মদী মুসলিম নামে পরিচিত। আহ্মদীরা সেই এক অদ্বিতীয় আল্লাহ্তে বিশ্বাসী যিনি সকল সুন্দর সুন্দর নামের অধিকারী। কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের হেদায়াত ও পথ প্রদর্শনের জন্য তিনি শেষ শরীয়ত গ্রন্থ কুরআন শরীফ পাঠিয়েছেন। এর ধারক ও বাহক হলেন খাতামান্নাবীঈন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম। তিনি সমগ্র মানব মন্ডলীর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ শরীয়তধারী নবী। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর মত আর কোন নবী আবির্ভূত হবেন না। তবে তাঁর পূর্ণ আনুগত্য ও অনুবর্তিতায় এবং তাঁর (সাঃ) মাঝে পূর্ণ বিলীন হয়ে কেউ নেয়ামত প্রাপ্ত হয়ে উম্মতী নবী হিসাবেও আখ্যায়িত হতে পারেন। (সূরা নিসাঃ ৭০)
রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম বলেছিলেনঃ
আখেরিনদের যুগের মুসলমান ইসলামকে বিকৃত করে দিবে আর নিজেদের মনগড়া ধর্ম বিশ্বাস ও কার্য-কলাপকে ইসলামের নামে চালাতে থাকবে। এ সময়ে পরম করুণাময় আল্লাহ্ তা’আলা নবীর (সাঃ) শ্রেষ্ঠ উম্মতকে নিঃসহায় অবস্থায় পরিত্যাগ করবেন না। বরং তাদের মাঝে ঐক্য সৃষ্টি ও তাদের সংশোধনের জন্য হযরত ইমাম মাহ্দী ও মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-কে পাঠাবেন। তিনি ধর্মকে সঞ্জীবিত করবেন এবং শরীয়তকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। সেই নামের মুসলমানকে কাজের মুসলমান বানিয়ে দেবেন আর এ আধ্যাত্মিক বিপ্লব ও আন্তর্জাতিক প্রচারের মাধ্যমে ইসলাম সারা বিশ্বে বিজয় লাভ করবে।
ভারতবর্ষে পাঞ্জাব প্রদেশের গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ান গ্রামে হযরত মির্যা গোলাম আহ্মদ আলায়হেস সাল্লাম আল্লাহ্তাআলার আদেশে ইমাম মাহ্দী ও প্রতিশ্রুত মসীহ্ দাবী করেন। বিশেষ করে সমস্ত মুসলিম উম্মতকে এবং সাধারণভাবে সারা মানব মন্ডলীকে একই কলেমা,“লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ” এর পতাকাতলে সমবেত করার লক্ষ্যে তিনি ১৮৮৯ সনে এ জামাতের প্রবর্তন করেন ঐশী নির্দেশনায়। হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহ্মদ মুজতাবা সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের জামালী অর্থাৎ সৌন্দর্য বিকাশক ‘আহ্মদ’ নাম অনুযায়ী ১৯০১ সনে তিনি (আঃ), এর নাম রাখেন ‘মুসলিম ফিরকা আহ্মদীয়া’। বিরুদ্ধবাদীরা এর অন্যান্য নাম দেয়। কেউ কেউ আপত্তি করে থাকেন যে, হযরত মির্যা গোলাম আহ্মদ (আঃ) এর নামানুযায়ী এ জামাতের নাম আহ্মদীয়া জামা’ত রাখা হয়েছে। এটা ঠিক নয়। শেষ যুগে হেদায়াত প্রাপ্ত জামাতের নাম যে আহ্মদীয়া জামা’ত হবে তা ইসলামের অনেক বুযুর্গ ঐশী ইঙ্গিতে তাদের পুস্তকে লিখে গেছেন। (যেমন হযরত মুজাদ্দিদ আলফে সানী (রহঃ) লিখিত মাবদা ওয়া মা’আদ পুস্তক ৫৮ পৃষ্ঠা এবং হযরত মুল্লা আলী আল্ কারী (রহঃ) লিখিত মেশ্কাতের শরাহ্ মিরকাত প্রথম খন্ড, ২৪৬ পৃষ্ঠা)। নবী করীম (সাঃ) এর বক্তব্য ‘ওয়া হিয়াল জামা’ত’ অনুযায়ী তা হবে একটি জামা’ত। আহ্মদী জামা’তই প্রকৃত পক্ষে সেই জামা’ত, আহ্মাদীয়াত ই সেই মহান আধ্যাত্মিক বিপ্লব। আহ্মদীয়া জামাতের প্রতিষ্ঠাতা সারা জীবন আরবী, ঊর্দূ ও ফার্সী ভাষায় ইসলাম ও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)- এর সত্যতা ও মাহাত্ম্য প্রভৃতি বিষয়ে বহু পুস্তক-পুস্তিকা লিখে সারা বিশ্বে এ আধ্যাত্মিক বিপ্লবের সূচনা করে গেছেন। ১৯০৮ সনে তাঁর (আঃ) ইন্তেকালের পরে প্রতিশ্রুত ঐশী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়।
এখন এ খেলাফতের পঞ্চম পর্যায় চলছে। প্রত্যেক খলীফার যুগেই আহ্মাদীয়াত আল্লাহ্র ফযলে আশ্চর্য ধরনের অগ্রগতিসাধন করেছে। বর্তমানে এ জামা’ত বিশ্বের প্রায় ১৮৯ টি দেশে স্থানীয় পর্যায়ে হাজার হাজার কেন্দ্র, হাজার হাজার মসজিদ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেছে। পৃথিবীর ৬৫ টির অধিক ভাষায় পবিত্র কুরআনের তরজমা তফসীর, ১২০ টির অধিক ভাষায় পবিত্র কুরআন, হাদীস ও মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর কালামের নির্বাচিত অংশসমুহের অনুবাদ এবং বিভিন্ন ইসলামী সাহিত্যের প্রচুর সমাবেশ ঘটিয়ে সারা বিশ্বে একটি নব জাগরণ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে মুসলিম টেলিভিশন আহ্মদীয়া ইন্টারন্যাশনাল (এম.টি.এ)-এর মাধ্যমে দিনরাত্র ইসলামের প্রচারের এক নব-দিগন্তের উন্মোচন করেছে আহ্মদীয়া জামা’ত। ইসলামের সৌন্দর্যপুর্ণ শিক্ষার বিস্তৃতিদান কার্যক্রমের অংশ হিসাবে পশ্চাৎপদ মানবগোষ্ঠীতে বিশেষতঃ আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং সেবামুলক কাজে বহু হাসপাতাল, ক্লিনিক ইত্যাদি নির্মাণ করে চলেছে এই জামা’ত।
আহ্মদীয়াত এরূপ এক বৃক্ষ, যাতে সদা বসন্ত বিরাজমান। এটা সেই বৃক্ষ, যাকে প্রকৃত মালিক খোদা তা’আলা নিজ হাতে রোপন করেছেন। এর ফল-ফলাদি সুমিষ্ট ও বিশ্বজনীন। এটা ইসলামের নবজীবন দানকারী বৃক্ষ। যে একে কাটতে চায় সে নিজেই কাটা পড়ে। যে এর ক্ষতি করার চেষ্টা করে সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিফল ও অকৃতকার্য হয়ে যায়। এটা সেই পবিত্র বৃক্ষ, যার মালী স্বয়ং খোদা।
আহ্মদীয়াতের প্রকৃত রূপ বুঝতে হলে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারনা করা প্রয়োজন। তা হলো, ইসলামের খোদা এক জীবিত ও চিরঞ্জীব-চিরস্থায়ী খোদা। তাঁর সত্তার অন্যতম প্রমাণ হলো, তিনি তাঁর বান্দাদের দোয়া শুনে থাকেন এবং জবাব দেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
উদউনী আস্তাজিব্লাকুম
অর্থাৎ হে আমার বান্দারা, তোমরা আমাকে ডেকো, আমি তোমাদের দোয়া শুনবো। (সূরা মু’মিননঃ ৬১)
কিন্তু পরিতাপের সাথে বলতে হয় যখন এ আখেরী যুগে মুসলমানদের মাঝে ধর্ম-বিশ্বাস ও আমলের দুর্বলতা দেখা দিল, তখন তারা এসব সুন্দর শিক্ষাকে পুরোপুরি ভুলে বসলো। দোয়ার জবাবদানকারী জীবিত খোদার ওপর থেকে তাদের বিশ্বাস উঠে গেল। তারা আল্লাহ্র সাক্ষাৎ এবং ওহী ইলহামের অস্বীকারকারী হয়ে গেল। তারা খোদাকে এক নিছক দর্শনে ও কেচ্ছা-কাহিনীতে পরিণত করলো।
এ চুড়ান্ত অন্ধকার ও নৈরাশ্যের জগতে কাদিয়ানের অজ্ঞাত-অখ্যাত পল্লী থেকে ইমাম মাহ্দী ও প্রতিশ্রুত মসীহ্ হযরত মির্যা গোলাম আহ্মদ (আঃ) কর্তৃক তৌহীদের ধ্বনি অতি প্রতাপের সাথে উচ্চারিত হলোঃ
“সেই খোদা এখনো যাকে চান কলীমে পরিণত করেন। তিনি এখনো তার সাথে কথা বলেন যাকে তিনি ভালবাসেন।”
হযরত মির্যা গোলাম আহ্মদ কাদিয়ানী (আঃ) হতোদ্যম মুসলমানদেরকে এ মহা সুসংবাদ শোনালেন,
“আমাদের খোদা এক জীবিত খোদা।”
তিনি আরো বলেন,
“জীবিত ধর্ম তা-ই যার মাধ্যমে জীবিত খোদা লাভ হয়। জীবিত খোদা তিনিই, যিনি মাধ্যম ছাড়াই আমাদের ইলহাম প্রাপ্ত করতে পারেন।”
আহ্মদীয়াত এ শেষ যুগে পৃথিবীকে যে ইসলামী সমাজ দান করেছে, এটা আসলে এ আন্তর্জাতিক বিপ্লবের সূচনালগ্ন। এর কল্যাণে বিশ্ব বর্তমান শতকে ইনশাআল্লাহ্ এক আধ্যাত্মিক দৃশ্য দেখবে। নতুন বিশ্ব হবে আর নতুন আকাশ এবং সারা বিশ্ব ইসলামের সূর্য রশ্মিতে আলোকনন্দিত হবে। কেননা সেদিন বেশী দূরে নয় যেদিন আহ্মদী জামাতের সকল প্রচার ও প্রকাশনার মাধ্যমে ইসলাম তথা আহ্মদীয়াত বিশ্বের সমস্ত দেশ ও জাতিকে নিজের মাঝে আত্মস্থ করে নিবে। সেদিন সারা বিশ্বে এক লা-শরীক খোদার ইবাদত প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সারা বিশ্বের একজনই নেতা হবেন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম, আর একটিই ধর্ম হবে ইসলাম, যার অন্য নাম আহ্মদীয়াত।
Leave a Reply