November 14, 2024, 9:57 pm
আমাদের প্রাণপ্রিয় ইমাম সৈয়্যদানা হযরত আমীরুল মুমিনীন খলীফাতুল মসীহ্ আল-খামেস (আই.) গত ৩ জুলাই, ২০২০ ইসলামাবাদ, টিলফোর্ডের মসজিদে মোবারক থেকে মহানবী (সা.)-এর বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের ধারাবাহিক স্মৃতিচারণ করে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরাফাতিহা পাঠের বলেন, বিগত খুতবায় হযরত সা’দ বিন মুআযের স্মৃতিচারণ করা হচ্ছিল। বদরের যুদ্ধের প্রাক্কালে সা’দ বিন মুআযআনসারদের পক্ষ থেকে মহানবী (সা.)-এর সিদ্ধান্তের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন ও বিশ্বস্ততার অনুপম স্বাক্ষর রেখেছিলেন, যা বিগত খুতবাতেও বর্ণিত হয়েছে; সেই ঘটনাটি হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) কিভাবে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বর্ণনা করেছেন- তা আজ হুযূর (আই.) তুলে ধরেন।
হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-এর মতে প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ এটি চায় না যে তার ভালবাসার ও প্রিয় মানুষটির কোন ক্ষতি বা কষ্ট হোক। এজন্যই সাহাবীরা এটা চাইতেন না যে রসূলুল্লাহ্ (সা.) যুদ্ধে যান; এমনটি নয় যে তারা নিজেদের জীবন নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, বরং তারা রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কষ্ট বা ক্ষতি নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন। একারণেই বদরের যুদ্ধের পূর্বে যখন মদীনা থেকে সাহাবীরা যাত্রা করেন, তখন তারা চাইছিলেন যেন কুরায়শদের সিরিয়া-ফেরত কাফেলার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু যখন রসূলুল্লাহ্ (সা.) আল্লাহ্ তা’লার কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে সাহাবীদের এটি জানান যে লড়াই বাণিজ্য-কাফেলার সাথে নয়, বরং কুরায়শদের সৈন্যবাহিনীর সাথে হবে এবং একইসাথে তাদের পরামর্শও চান, তখন শীর্ষস্থানীয় সাহাবীরা অকুণ্ঠচিত্তে তাঁকে সমর্থন করেন। মুহাজির সাহাবীদের একের পর এক উদ্দীপনামূলক বক্তব্যের পরও যখন হুযূর (সা.) আরও পরামর্শ আহবান করেন, তখনই হযরত সা’দ বিন মুআয দাঁড়িয়ে আনসারদের পক্ষ থেকে একথা বলেন যে তারা তো এজন্য কুরায়শদের সাথে লড়াইয়ের বিষয়ে কিছু বলছেন না পাছে তাদের মুহাজির ভাইয়েরা একথা মনে করেন যে আনসাররা হয়তো মুহাজিরদের জ্ঞাতিভাইদের হত্যা করতে আগ্রহী; নতুবা তারা তো রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নির্দেশে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতেও প্রস্তুত! আর আকাবার রাতে যে আনসাররা অঙ্গীকার করেছিলেন- মদীনার ভেতরে তারা রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবেন- সেসময় তারা রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রকৃত মর্যাদা বুঝতে অপারগ ছিলেন। এখন যেহেতু তাদের আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টি উন্মিলিত হয়েছে এবংতারা তাঁর (সা.) প্রকৃত পদমর্যাদা জানতে পেরেছেন, তাই মদীনার ভেতরে বা বাহিরের প্রশ্নই ওঠে না,তারা রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নিরাপত্তার স্বার্থে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে যেতে প্রস্তুত; তারা রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সামনে-পেছনে, ডানে-বামে সর্বত্র লড়াই করবেন এবং শত্রু তাদের লাশ না ডিঙিয়ে হুযূর (সা.)-এর কাছে পৌঁছতে পারবে না।
সূরা রা’দের ১৩নং আয়াতে যে আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন- ‘লাহু মুআক্কিবাতুম্ মিম বায়নি ইয়াদাইহি ওয়া মিন খালফিহি’ অর্থাৎ “তার জন্য তার সামনে-পেছনে চলমান নিরাপত্তা-বিধানকারীরা নিয়োজিত রয়েছে”- এর ব্যাখ্যায় হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) মক্কায় থাকাকালীন তো কেবল আকাশের ফেরেশতারা তাঁর (সা.) সুরক্ষা ও নিরাপত্তাবিধান করেছেন, কিন্তু মদীনায় আসার পর আকাশের ফেরেশতাদের সাথে সাথে পৃথিবীর ফেরেশতারাও অর্থাৎ সাহাবীগণও এই দায়িত্ব পালন করেছেন। উপমাস্বরূপ তিনি (রা.) বদরের যুদ্ধের প্রাক্কালে আনসারদের পক্ষ থেকে হযরত সা’দ বিন মুআযের আত্মনিবেদনের সেই মহান ঘোষণা বিবৃত করেন। একজন সাহাবী যিনি মহানবী (সা.)-এর সাথে ১৩টি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তিনি একথা বলতেন, ‘আমার মনে অজশ্রবার এই আকাঙ্ক্ষা হয়েছে- হায়, যদি এই সব যুদ্ধে অংশগ্রহণের পরিবর্তে ঐ কথাগুলো বলার আমার সৌভাগ্য হতো, যা বদরের যুদ্ধের পূর্বে সা’দ বিন মুআয বলেছিলেন!’সীরাতে খাতামান্নাবীঈন’ পুস্তকে হযরত সাহেবযাদা মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.) লিখেছেন,হযরত হুবাব বিন মুনযেরের পরামর্শে মহানবী (সা.) রণকৌশলগত দিক বিবেচনা করে নিকটবর্তী ঝর্ণার কাছে শিবির স্থাপনের নির্দেশ দেন। হযরত সা’দ বিন মুআয সেখানে মহানবী (সা.)-এর জন্য একটি শামিয়ানা টানানোর নির্দেশ দেন ও হুযূর (সা.)-কে অনুরোধ করেন যে তিনি (সা.) যেন সেখানেই অবস্থান করেন ও যুদ্ধে অংশ না নেন; সাহাবীরা হুযূর (সা.)-কে ছাড়াই যুদ্ধ করবেন। আল্লাহ্না করুন, দুর্ভাগ্যক্রমে যুদ্ধে যদি মুসলমানরা পরাজিতও হন, তবুও যেন রসূলুল্লাহ্ (সা.) অক্ষত থাকেন এবং নিরাপদে মদীনায় ফিরে যান। হযরত সা’দ কেবলমাত্র রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতি গভীর ভালবাসা ও তাঁর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা থেকেই একথা বলেছিলেন, নতুবা ইতিহাস সাক্ষী যে আল্লাহ্ রসূল (সা.) সর্বদা যুদ্ধক্ষেত্রে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন; এমনকি হুনায়নের যুদ্ধের দিন মুসলিম বাহিনীর বার হাজার সৈন্যের পৃষ্ঠপ্রদর্শন সত্তে¡ও মহানবী (সা.) প্রায় একাই নির্ভয়ে শত্রুদের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন।উহুদের যুদ্ধের সময়ও জুমুআর দিন রাতে হযরত সা’দ বিন মুআয, সা’দ বিন উবাদা ও উসায়েদ বিন হুযায়ের অস্ত্রসজ্জিত হয়ে সারারাত রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর দুয়ারে পাহারা দিয়েছেন। যখন হুযূর (সা.) স্বয়ং অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে বের হন, তখন তাঁর বাহনের সামনে সামনে সা’দ বিন মুআয ও সা’দ বিন উবাদা দৌড়ে দৌড়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন।উহুদের যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় হযরত সা’দ বিন মুআয বীরদর্পে মহানবী (সা.)-এর ঘোড়ার লাগাম ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, যেন এটি বোঝাচ্ছিলেন যে ‘আমরা নিজেদের প্রাণ দিয়ে হলেও আল্লাহ্র রসূল (সা.)-কে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছি।’ উহুদের যুদ্ধে তার ভাই হযরত আমর বিন মুআয শাহাদাতবরণ করেছিলেন। যেহেতু মদীনায় গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে মহানবী (সা.)-ও শহীদ হয়ে গিয়েছেন- সেজন্য সা’দের বৃদ্ধা মা-ও ছুটে এসেছিলেন রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর খোঁজে। হযরত সা’দ যখন হুযূর (সা.)-কে বলেন যে তার মা আসছেন, তখন হুযূর (সা.) ঘোড়া দাঁড় করাতে বলেন। সেই ক্ষীণদৃষ্টি বৃদ্ধা নিজের ছেলেদের কোন খোঁজ না নিয়ে কেবল রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর খোঁজ নিচ্ছিলেন। হযরত সা’দ তাকে বলেন যে হুযূর (সা.)তার সামনেই রয়েছেন। মহানবী (সা.) তাকে বলেন, ‘মা! আমি খুবই দুঃখিত যে তোমার যুবক ছেলে যুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেছে।’ সেই মহিয়সী নারী উত্তরে বলেন, ‘হে আল্লাহ্র রসূল! আপনি যখন নিরাপদ আছেন, তখন ধরে নিন আমি আমার দুঃখকে ভুনা করে খেয়ে ফেলেছি!’ কত মহান ছিলেন সেসব সাহাবী ও সাহাবীয়াগণ, আর কতই না মহান ছিল তাদের আত্মত্যাগ!পৃথিবীর ইতিহাসে কোন নবী বা কোন নেতার জন্য তার মান্যকারীদের ত্যাগ বা আত্মোৎসর্গের এরূপ উদাহরণ কেউ দেখাতে পারবে না, যেমনটি রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাহাবীরা দেখিয়েছেন!
প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর (আই.) আমাদের আহমদী নারী-পুরুষদেরও ইসলাম-আহমদীয়াত ও খিলাফতের প্রতি আত্মনিবেদনের এই মানে উপনীত হওয়ার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেন।মদীনার ইহুদী নেতা কা’ব বিন আশরাফের মদীনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ষড়যন্ত্র,বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, যুদ্ধের উস্কানি প্রদান, অশ্লীলতা ছড়ানো এবং হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রের মত গুরুতর সব অপরাধের প্রেক্ষিতে মহানবী (সা.)মদীনা রাষ্ট্রের স্বার্থে মদীনার প্রধান প্রশাসকের অবস্থান থেকে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন এবং অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা এড়াতে গোপনে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য হযরত মুহাম্মদ বিন মাসলামাকে দায়িত্ব দেন; তিনি (সা.) তাকে বিশেষভাবে নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছিলেন যেন অবশ্যই হযরত সা’দ বিন মুআযের পরামর্শক্রমে এই কাজ সমাধা করা হয়। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর (আই.)এই ঘটনাটির পূর্বাপর ‘সীরাতে খাতামান্নাবীঈন’ পুস্তকের বরাতে তুলে ধরেন। ইহুদী গোত্র বনু নযীর একবার মহানবী (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে, কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা তা নস্যাৎ করে দেন। পরবর্তীতে তাদেরকে দেশান্তরের শাস্তি দেয়া হয়। বনু নযীর গোত্রের সম্পত্তি মহানবী (সা.) সা’দ বিন মুআয ও সা’দ বিন উবাদার অনুমতিক্রমে পুরোটাই মুহাজিরদের মধ্যে বন্টন করে দেন; সা’দ বিন মুআযকে মহানবী (সা.) তখন ইহুদী নেতা আবু হুকায়কের তরবারি উপহার দিয়েছিলেন, যা ইহুদীদের মধ্যে খুবই বিখ্যাত তরবারি ছিল। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.)-এর উপর যখন মিথ্যা অপবাদ রটনা করা হয়, তখন একদিন মহানবী (সা.) সাহাবীদের কাছে এসেএই ষড়যন্ত্রের মূল হোতার কারণে সৃষ্ট কষ্টের কথা বললে সা’দ বিন উবাদা অসাধারণ নিষ্ঠা প্রদর্শন করে বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ্র রসূল! সে যদি আমাদের কেউ হয়ে থাকে, তবে সে অওস বা খাযরাজ- যে গোত্রেরই লোক হোক না কেন- আমরা তাকে হত্যা করতে প্রস্তুত।’ পরিখার যুদ্ধের সময় কুরায়শ নেতা আবু সুফিয়ানবনু কুরায়যার ইহুদীদেরকে মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতায় প্রলুদ্ধ করে। মহানবী (সা.) যখন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এ বিষয়ে জানতে পারেন, তখন ইহুদীদের সাথে কথা বলার জন্য সা’দ বিন মুআয ও সা’দ বিন উবাদাকে পাঠান। তারা দু’জন সেখানে গিয়ে তাদের নেতা কা’ব বিন আসওয়াদের সাথে দেখা করলে সেই হতভাগা তাদের সাথে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করে এবং মহানবী (সা.)-এর সাথে সবরকমের সন্ধিচুক্তি অস্বীকার করে। পরিখার যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফেরার পথেই আল্লাহ্ তা’লা মহানবী (সা.)-কেদিব্যদর্শনে বনু কুরায়যাকে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দেন, যার প্রেক্ষিতে সাহাবীরা সবাই দ্রুত তাদের এলাকায় গিয়ে পৌঁছেন। বনু কুরায়যার বিশ্বাসঘাতকার শাস্তির বিষয়ে মীমাংসা প্রদানে হযরত সা’দ বিন মুআযের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, যার সুদীর্ঘ বিবরণ রয়েছে।হুযূর (আই.) বলেন, এর বিস্তারিত পরবর্তীতে বর্ণনা করা হবে, ইনশাআল্লাহ্।
Leave a Reply