November 19, 2024, 6:22 pm
নিখিলবিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বর্তমান ইমাম সৈয়্যদনা হযরত আমীরুল মুমিনীন খলীফাতুল মসীহ্ আল-খামেস (আই.) গত ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ইসলামাবাদ, টিলফোর্ডের মসজিদে মোবারক থেকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবাতেও মহানবী (সা.)-এর বদরী সাহাবী হযরত বিলাল বিন রাবাহ্ (রা.)-এর স্মৃতিচারণ অব্যাহত রাখেন।
হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, বদরী সাহাবীদের মধ্য থেকে গত শুক্রবার হযরত বিলাল (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করা হচ্ছিল, যা কিছু অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল; আজও তা বর্ণনা করব। হযরত আবু হুরায়রা বর্ণনা করেন, খায়বারের যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় মহানবী (সা.) রাতের বেলাতেও পথ চলতে থাকেন; যখন একেবারে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে পড়েন তখন যাত্রা-বিরতি করেন এবং হযরত বিলালকে বলেন, ‘আজ রাতে নামাযের সময়ের সুরক্ষা তুমি করো;’ অর্থাৎ তাকে ফজরের সময় জাগানোর দায়িত্ব প্রদান করেন। হযরত বিলাল জেগে নফল নামায পড়তে থাকেন, কিন্তু ফজরের সময়ের সামান্য পূর্বে ক্লান্তিতে তিনি নিজ বাহনের গায়ে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েন; ক্লান্তির কারণে সময়মত কারোই ঘুম আর ভাঙেনি। সূর্য ওঠার পর সূর্যের আলোয় সর্বপ্রথম রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ঘুম ভাঙে।
হুযূর (সা.) হযরত বিলালের নাম ধরে ডাকতে থাকেন; হযরত বিলাল ঘুম ভেঙে ছুটে আসেন ও পুরো ব্যাপার বলেন। মহানবী (সা.) যাত্রা শুরু করতে বলেন। সামান্য অগ্রসর হয়েই তিনি (সা.) থামেন ও নামাযের জন্য প্রস্তুত হয়ে সকলকে নিয়ে বাজামাত নামায পড়েন। নামায শেষে রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “কেউ যদি নামায পড়তে ভুলে যায়, তাহলে তার উচিত যখনই তার মনে পড়ে, সে যেন তখনই নামায পড়ে নেয়; কেননা আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন: ‘আমাকে স্মরণ করার জন্য নামায কায়েম কর’।
মহানবী (সা.) মক্কা-বিজয়ের দিন যখন কা’বা ঘরের ভেতর প্রবেশ করেন, তখন তাঁর সাথে হযরত বিলাল, উসামা বিন যায়েদ ও উসমান বিন তালহাও ছিলেন; ভেতরে ঢুকে তারা দরজা বন্ধ করে দেন। তারা বের হলে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর, হযরত বিলালের কাছে ছুটে গিয়ে জানতে চান যে রসূলুল্লাহ্ (সা.) কা’বার ভেতরে নামায পড়েছেন কি-না। উত্তরে হযরত বিলাল জানান যে রসূলুল্লাহ্ (সা.) কা’বার দুই স্তম্ভের মধ্যখানে নামায পড়েছেন। সেদিন হুযূর (সা.) হযরত বিলালকে কা’বা শরীফের ছাদে উঠে আযান দিতে বলেছিলেন; বিলাল তা-ই করেছিলেন। মক্কা সেই নগরী, যেখানে হযরত বিলালকে একসময় চরম অত্যাচার, অপমান ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছিল।
মক্কা-বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) আশ্চর্য মধুর উপায়ে তার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। মুসলিম বাহিনী মক্কায় প্রবেশের পূর্বেই আবু সুফিয়ান যখন ইসলাম গ্রহণ করে, তখন একইসাথে মক্কাবাসীর সুরক্ষার ব্যবস্থার জন্যও মহানবী (সা.)-এর কাছে আবেদন জানায়। হুযূর (সা.) বেশ কয়েকটি সুযোগ দেন; তিনি (সা.) বলেন, যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে কিংবা কা’বার চত্বরে আশ্রয় নেবে, অথবা অস্ত্র ফেলে দেবে বা নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে থাকবে তাদের কাউকেই কিছু করা হবে না। আবু সুফিয়ান বলে, তবুও তো অনেকের জন্য শংকা থেকে যাবে।
তখন রসূলুল্লাহ্ (সা.) হযরত বিলালের ধর্মভাই আনসারী সাহাবী আবু রুওয়াইহাকে ডেকে তার হাতে একটি পতাকা দেন এবং মক্কায় প্রবেশের সময় এই ঘোষণা করতে বলেন ‘এটা বিলালের পতাকা; যে এর নিচে আশ্রয় নেবে, সে নিরাপদ থাকবে।’ বস্তুতঃ যখন মুসলিম বাহিনী মক্কায় প্রবেশ করে তখন কুরায়শদের অনেকেই নিরাপত্তার জন্য হযরত বিলালের পতাকাতলে এসে আশ্রয় নেয়। মহানবী (সা.) ও মুহাজিরগণ যদিও একসময় মক্কাবাসীদের ভয়াবহ অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন, কিন্তু তবুও তারা তাদের রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয়ই ছিল; একমাত্র হযরত বিলাল-ই সেই ব্যক্তি ছিলেন, যার মক্কায় কোন আত্মীয় ছিল না। এ কারণে তাদেরকে ক্ষমা করলে হয়তো হযরত বিলালের মনের কোণে একটা দুঃখ থেকে যেত যে ‘রসূলুল্লাহ্ (সা.) তার জ্ঞাতি-ভাইদের তো ক্ষমা করে দিলেন, কিন্তু আমার অপমানের প্রতিশোধ নেয়া হল কোথায়?’ কিন্তু রসূলুল্লাহ্ (সা.) এত মধুর উপায়ে প্রতিশোধ নিলেন যে একদিন যারা জুতো পরে বিলালের বুকের উপর নাচতো, তারাই আজ নিজেদের প্রাণ রক্ষার্থে যেন বিলালের পদতলে এসে ঠাঁই নিচ্ছে। তাদের হত্যা করেও তো হযরত বিলালের পক্ষে এমন চরম প্রতিশোধ নেয়া সম্ভব ছিল না!
মহানবী (সা.) পৃথিবীকে দেখিয়ে দিলেন যে রক্তপাত না ঘটিয়েই ইসলাম কত সুন্দর ও মধুরভাবে প্রতিশোধ নিতে পারে।প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর (আই.) আরও একটি বিষয় স্পষ্ট করেন; হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এই ঘটনাটিকে তার বিভিন্ন রচনায় ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ আপত্তি করে বসে যে ‘অমুক স্থানে তো বর্ণনা এমন ছিল, এখানে এমন কেন?’ ইত্যাদি। বস্তুতঃ বর্ণনা একটিই, কিন্তু কোথাও তা কিছুটা বিস্তারিত, কোথাও সংক্ষিপ্ত; কিন্তু মূল বিষয়বস্তু একই। আলোচনার প্রেক্ষাপটের ভিন্নতার কারণে একেক স্থানে একেকটি বিষয়ের উপর আলোকপাতে কম-বেশি হয়ে থাকে।মহানবী (সা.) যখন ঈদের দিন ঈদগাহে নামাযের জন্য যেতেন, তখন একজন তাঁর (সা.) বর্শাটি হাতে নিয়ে সামনে সামনে এগোত; অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব পালন করতেন হযরত বিলাল। রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর তিরোধানের পর হযরত বিলাল হযরত আবু বকরের জন্যও এভাবে যেতেন।
রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর তিরোধানের পর হযরত বিলাল হযরত আবু বকরের কাছে এসে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন; কারণ রসূলুল্লাহ্ (সা.) তাকে বলেছিলেন, ‘হে বিলাল! আল্লাহর পথে জিহাদের চেয়ে উত্তম আর কোন ইবাদত নেই।’ হযরত আবু বকর আল্লাহর দোহাই দিয়ে তাকে থাকতে বলেন এবং বলেন, ‘আমি বুড়ো ও দূর্বল হয়ে গিয়েছি, আমার মৃত্যুও সন্নিকট; তুমি আমার কাছে থাক!’ হযরত আবু বকরের অনুরোধে বিলাল মদীনায় থেকে যান। হযরত আবু বকরের তিরোধানের পর হযরত উমর খলীফা হলে তিনি তার কাছে এসেও একই নিবেদন জানান; হযরত উমরও আবু বকরের সুরেই কথা বলেন। কিন্তু এবার হযরত বিলাল জিহাদে যাওয়ার সংকল্পে অনড় ছিলেন, ফলে হযরত উমর বাধ্য হয়ে তাকে অনুমতি দেন এবং হযরত বিলাল সিরিয়ায় চলে যান। হযরত উমর যখন তার কাছে জানতে চান যে তার পর আযান দেয়ার দায়িত্ব কে নেবে, তখন হযরত বিলাল হযরত সা’দের নাম বলেন; কারণ সা’দ রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জীবদ্দশাতেও আযান দিয়েছিলেন। ফলে হযরত উমর হযরত সা’দ ও তার পরে তার সন্তানদের উপর আযানের দায়িত্ব অর্পণ করেন। সিরিয়ায় মুসলিম-বাহিনীর জয়ের পর যখন হযরত উমর সিরিয়া যান, তখন হযরত উমরের অনুরোধে হযরত বিলাল আযান দিয়েছিলেন। বর্ণনাকারীর মতে ‘সেদিনের পূর্বে আমরা তাকে কখনও এতটা কাঁদতে দেখি নি।’
হযরত বিলাল যখন সিরিয়ায় ছিলেন, তখন একদিন স্বপ্নে দেখেন যে রসূলে করীম (সা.) তার কাছে এসে বলছেন, ‘বিলাল, তুমি তো আমাকে ভুলেই গিয়েছ! আমার কবর যিয়ারত করতেও আর আস না!’ হযরত বিলাল তৎক্ষণাৎ মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। মদীনায় পৌঁছে তিনি রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কবরে গিয়ে এত দোয়া ও কান্নাকাটি করেন যে খবর ছড়িয়ে পড়ে বিলাল এসেছেন। হযরত হাসান ও হুসায়ন ততদিনে বেশ বড় হয়ে গিয়েছেন; তারা ছুটে এসে হযরত বিলালের সাথে দেখা করে বলেন, আপনি তো রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর যুগে আযান দিতেন, আমাদেরকেও আপনার আযান শোনান। হযরত বিলাল তখন মদীনায় আযান দেন। সেই আযান শুনে প্রত্যেক মদীনাবাসী শিহরিত হয়ে জেগে ওঠে; তাদের সবার হৃদয়ে রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর যুগের সেই স্মৃতি জাগ্রত হয়ে ওঠে এবং পুরো মদীনা আবেগে কান্নায় ভেঙে পড়ে।একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, বনু আবু বুকায়র মহানবী (সা.)-এর কাছে আসে এবং বলে, ‘অমুক ব্যক্তির সাথে আমাদের বোনের বিয়ে করিয়ে দিন।’
মহানবী (সা.) তখন বলেন, ‘বিলালের ব্যাপারে তোমাদের মত কী?’ তারা তখন চলে যায়। কয়েকবার এরূপ ঘটে এবং প্রতিবারই মহানবী (সা.) হযরত বিলালের জন্য তাদেরকে প্রস্তাব দেন। শেষবার তিনি তাদেরকে বিলালের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘সেই ব্যক্তির ব্যাপারে তোমাদের অভিমত কী, যে জান্নাতের বাসিন্দা?’ তখন তারা হযরত বিলালের সাথে বোনের বিয়ে দিতে সম্মত হয়। হযরত উমর তার খিলাফতকালে একবার মক্কায় এলে পরে মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তার সাথে সৌজন্য-সাক্ষাৎ করতে আসে। ঘটনাচক্রে একই সময়ে হযরত বিলাল, আম্মার, সুহায়েব প্রমুখ সাহাবীরাও তার সাথে দেখা করতে আসেন। এই সাহাবীরা যদিও একসময় মক্কার লোকদের ক্রীতদাস ছিলেন, কিন্তু তারা প্রথমদিকে ইসলাম গ্রহণ করে চরম অত্যাচারও সয়েছিলেন এবং রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর দরবারে তারাই অগ্রগণ্য হতেন। তারা একজন একজন করে আসছিলেন আর হযরত উমর মক্কার নেতাদের পিছিয়ে গিয়ে তাদেরকে স্থান দিতে বলছিলেন; এভাবে পেছাতে পেছাতে তারা কার্যতঃ দরজার বাইরেই চলে যায়। এই ঘটনায় তারা খুবই অপমানিত বোধ করে, কিন্তু তাদেরই একজন তখন স্মরণ করিয়ে দেয় যে তাদের কপালে আজ যে লাঞ্ছনা জুটেছে, তা তাদেরই বাপ-দাদাদের কর্মফলের কারণে হয়েছে।
কারণ তাদের বাপ-দাদারা প্রথমদিকে ইসলামের বিরোধিতা করেছে ও এই সাহাবীদের অত্যাচার করেছে। তারা যখন হযরত উমরের কাছে গিয়ে এই বিষয়টি বলে এবং জানতে চায় যে তাদের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার কোন পথ আছে কি-না। হযরত উমর তাদের সিরিয়ার দিকে ইশারা করে বোঝান, এর একমাত্র সমাধান হল আল্লাহ্র পথে জিহাদ করা। সেই যুবকরা সাথে সাথে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তাদের একজনও জীবিত ফিরে আসে নি। এভাবে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের কর্মকাণ্ডের কারণে তাদের কপালে লেগে থাকা কালিমা নিজেদের রক্ত দিয়ে মুছেছিলেন। হুযূর (আই.) বলেন, এত্থেকে একদিকে যেমন এটি বোঝা যায় যে মর্যাদা পেতে হলে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, সেইসাথে ইসলামের এই অনিন্দ্য-সুন্দর শিক্ষাটিও স্পষ্ট হয় যে যারা বড় ত্যাগ স্বীকার করে এবং প্রথম থেকেই বিশ্বস্ততা প্রদর্শন করে, তাদের মর্যাদা অবশ্যই উচ্চ এবং তারাই অগ্রগণ্য, তা সে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসই হোক বা জাগতিকভাবে অনেক তুচ্ছ ব্যক্তিই হোক। হুযূর বলেন, হযরত বিলালের স্মৃতিচারণ অব্যাহত রয়েছে, পরবর্তীতেও তা বর্ণনা করা হবে, (ইনশাআল্লাহ্)।
Leave a Reply