November 15, 2024, 4:40 pm
হযরত আলহাজ্ব হাকীম মাওলানা নূরুদ্দীন (রাঃ) খলিফাতুল মসীহ্ আউয়াল একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব ছিলেন-তিনি একাধারে মেধাবী প্রণেতা, প্রখ্যাত পণ্ডিত,অসাধারণ পুণ্যবান এবং বিশিষ্ট ধর্মজ্ঞ ব্যক্তি।
চিকিৎসা শাস্ত্রের একজন বিশারদ হওয়ার সুবাদে দীর্ঘদিন তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজার রাজ-চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৮৪১ সালে পাঞ্জাবের ভেরা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জ্ঞান আহরণের লক্ষ্যে তিনি দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করেন এবং এই সুবাদে চার বৎসর পবিত্র নগরী মক্কা ও মদীনায় অবস্থান করার সৌভাগ্য লাভ করেন। আহ্মদীয়াতের ইতিহাসের বিবরণীতে তাঁর ইসলামের সেবা অতুলনীয়। প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আঃ) পার্শী দ্বিপদীতে তাঁর উচ্চপ্রশংসা করেছেন, যা তাঁর উৎসর্জন এবং মর্যাদার স্বীকৃতির একটি মনোরম প্রামাণিক সাক্ষ্য।
“কতইনা প্রশান্তিদায়ক হতো যদি আমার প্রতিটি অনুসারী নুরুদ্দীন হতেন, এটা কেবল তখনই সম্ভব যখন কারো হৃদয় সত্যের আলোকে এবং বিশ্বাসের দৃঢতায় উদ্দীপিত হয়”
কাদিয়ানে তাঁর একমাত্র অনুসন্ধান ছিল ধর্মীয় শিক্ষণ। প্রথমত তাঁর উদ্বেগ ছিল দরিদ্রদের অবস্থার উন্নয়ন। তাঁর সীমিত উপার্জন সত্ত্বেও উদারতা তাঁর আচরণকে পরিব্যাপ্ত করে ছিল। তিনি নম্রতা, দয়া, ধৈর্য্য এবং আত্মত্যাগের অনুশীলন করতেন; যা তাঁকে পারিপার্শ্বিক সবার নিকট আদরণীয় করে তুলেছিল। তিনি কখনও প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আঃ)-এর অনুমতি ব্যতীত কাদিয়ানের বাইরে যাওয়ার অথবা কোন কিছু লিখারও স্পর্ধা রাখতেন না।
ঐশী নির্দেশে হযরত প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আঃ) ১৮৮৯ সালের ২৩ শে মার্চ বয়’আত গ্রহণ শুরু করেন। সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি বয়’আত গ্রহণ করেন তিনি হলেন মাওলানা হাকীম নূরুদ্দীন (রাঃ)। মসীহ্ মাউদ (আঃ)-এর প্রতি তাঁর অনুরক্ততা এবং উৎসর্জন ছিল পরিপূর্ণ এবং সর্বোত।
১৮৯৩ সালে তিনি ব্যক্তিগত কিছু কাজে এক সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে লাহোর আসেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে একদিনের জন্য কাদিয়ান পরিদর্শন করবেন, যা সেখান থেকে বেশি দূরে ছিল না। সেই একটি দিন তাঁর গোটা জীবনের গতিপথ পালটে দেয়। ভেরায় তিনি একটি বিরাট হাসপাতাল নির্মাণ করছিলেন কিন্তু প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আঃ)-এর পরামর্শে তিনি কাদিয়ানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন এবং জীবনে কখনও তাঁর পৈতৃক বসত বাড়ীতে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করেননি, এতই গভীর ছিল আধ্যাত্মিক গুরুর প্রতি তাঁর ত্যাগ এবং আনুগত্য।
সন ১৯০৫, হযরত প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আঃ) দিল্লীতে তাঁর অসুস্থ্য শ্বশুর হযরত মীর নাসের নওয়াব সাহেবকে দেখতে যান। দিল্লী থেকে হুযূর কাদিয়ানে অবস্থানরত হযরত মাওলানা হাকীম নূরুদ্দীন সাহেবকে একটি টেলিগ্রাম পাঠান যেন তিনি জরুরী ভিত্তিতে দিল্লী পৌঁছেন। এত মহান ছিল মাওলানা সাহিবের মান্যতা এবং আনুগত্যের উপলব্ধি যে তিনি সেই মুহূর্তে তাঁর ক্লিনিক থেকেই দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন, ট্রেনের ভাড়া কিংবা অন্যান্য খরচের বিষয়টিও ভাবলেন না। তাঁর এক বন্ধুকে বললেন,
“এক মুহুর্ত বিলম্ব করাকে আমি পাপ মনে করি। এটা আমার গুরুর পক্ষ থেকে আহ্বান। আমি আমার আপন প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আল্লাহতা’লার উপর ভরসা রাখি”।
ঘটনা এমনটি ঘটলো যে, যখন তিনি বাটালা রেলস্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত, তখন তাঁরই একজন ধনবান রোগীর সাথে দেখা হয়ে গেল। তিনি তাঁকে কেবল দিল্লীগামী ট্রেনের টিকিটেরই ব্যবস্থা করলেন না বরং তাঁকে যথেষ্ট পরিমান নগদ অর্থও তোহফা স্বরূপ প্রদান করলেন।
হযরত আলহাজ্ব হাকীম মাওলানা নূরুদ্দীন (রাঃ) খলিফাতুল মসীহ্ আউয়াল, একজন পূত-পবিত্র এবং সাদাসিধে মানুষ ছিলেন; তিনি সহনশীল, অমায়িক, অকপট এবং সত্যপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন।
তিনি চমৎকার প্রশাসনিক এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। আল্লাহতা’লার প্রতি তাঁর অসাধারণ বিশ্বাস ছিল। আল্লাহতা’লার উপর তাঁর আস্থা দৃষ্টান্তস্থানীয় এবং তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।
নিম্নোক্ত দু’টি ঘটনাচিত্র এই বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত বহন করেঃ
একদা, মদীনায় বসবাসকালে তাঁর নিকট রাতে খাবারের জন্য কিছুই ছিল না, মসজিদে নববী অভিমুখে নামাযের উদ্দেশ্যে যাবার পথে পুলিশের এক লোক তাঁকে সালাম জানায় এবং তাঁর কর্মকর্তার নিকট সাক্ষাতের জন্য নিয়ে আসে। সেই পুলিশ কর্মকর্তা একপ্লেট মিষ্টি সামনে নিয়ে বসে ছিল। সেগুলো খুবই সুস্বাদু এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভারতীয় মিষ্টান্ন ছিল, যা কোন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তির সহায়তায় তৈরী করা হয়েছিল। তিনি বলেন, “আমি ভাবছিলাম এগুলো আমার কোন ভারতীয়ের সাথে মিলে খাওয়া উচিত”।
আর এভাবেই অলৌকিক ভাবে তাঁকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো হলো।
ভেরার কুরাইশী আমীর মোহাম্মদ সাহেব বর্ণনা করেনঃ
আমি হযরত খলিফাতুল মসীহ্ (রাঃ) এর সমীপে উপস্থিত ছিলাম, তখন এক পিয়ন একটি ভি পি পার্শেল নিয়ে এল, যাতে কিছু পুস্তক ছিল, এটার জন্য তাঁকে ১৬ রূপী পরিশোধ করতে হতো। তিনি চমৎকৃত হলেন যে এইগুলো তাঁর খুবই পছন্দের পুস্তক, যা তিনি কিছুদিন পূর্বে চেয়ে পাঠিয়েছিলেন কিন্তু এখন তাঁর নিকট এটি পরিশোধ করার অর্থ নেই। তিনি বলেন, “আমার প্রতি আল্লাহতা’লার এতই করুণা রয়েছে যে আমি নিশ্চিত তিনি এই মুহূর্তেই তাঁর বদান্যতা প্রদর্শন করবেন”। তখনই এক হিন্দু ভদ্রলোক তার অসুস্থ্য বাচ্চাকে নিয়ে আসে। মাওলানা সাহেব তাকে পরীক্ষা করেন এবং একটি প্রেসক্রিপশন লিখে দেন। লোকটি তাঁর সামনে একটি গিনি (যার মূল্যমান তখন ১৫ রূপী) এবং অতিরিক্ত একটি রূপী কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রেখে চলে যায়।
হযরত মাওলানা সাহেব তৎক্ষনাৎ আল্লাহতা’লার কৃতজ্ঞতায় সিজদায় পড়ে যান। আমি দৃঢপ্রতিজ্ঞ ছিলাম যে আমার প্রভূ, আমার প্রিয়বন্ধু কখনও আমাকে পরিত্যাগ করবেন না। হয়ত লোকটি মোটেই কিছু দিত না, যেহেতু সাধারণভাবে আমি কিছুই চাই না অথবা সে হয়ত কেবল গিনিটিই দিয়ে যেতে পারত। কিন্তু আমার আল্লাহ চাইলেন যেন তাঁর বান্দার চাহিদা পুরোপুরি পূরণ করা হয়”।
প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আঃ)-এর ইন্তেকালের পর, ১৯০৮ সালের ২৭শে মে হযরত মাওলানা হাকীম নূরুদ্দীন(রাঃ) তাঁর প্রথম খলীফা হিসেবে সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হন।
তিনি খলীফার মসনদে আসীন থেকে তাঁর মৃত্যুকাল ১৯১৪ সালের ১৩ই মার্চ পর্যন্ত জামা’তকে নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দেন।
তাঁর মৃত্যুর সংবাদ খবরের কাগজের মাধ্যমে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাঁর মর্যাদাপূর্ণ কৃতিকার্যের প্রশংসা করে মন্তব্য লিখা হয়। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য পত্রিকাগুলো হলোঃ ‘জমিন্দার’ এবং ‘পইসা’ লাহোর; ‘তাবীব’ এবং ‘হামদর্দ’ দিল্লী; ‘আল-হিলাল’ কোলকাতা; ‘মদীনা’, ‘বিজনূর’, ‘ওয়াকিল’ এবং ‘ওয়াতান’ অমৃতসর এবং ‘ইনস্টিটিউট গেজেট’ আলীগড়।
‘জমিন্দার’ পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা জাফর আলী লিখেনঃ
“মাওলানা হাকীম নূরুদ্দীন সাহেব, যিনি একজন মহান এবং বিদ্বান পণ্ডিত ছিলেন,দীর্ঘ অসুস্থ্যতার পর গত ১৩ই মার্চ পরলোকগমন করেছেন। তাঁর ইন্তেকাল একটি সমূহ ক্ষতি এবং তা মুসলিম সমাজে একটি শূন্যতার সৃষ্ট করেছে। বলা হয়ে থাকে যে, একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি শতাব্দীর পর জন্ম গ্রহণ করে থাকেন। নিঃসন্দেহে তাঁর বিদেহী আত্মা এই মহান সম্মানের দাবী রাখে”।
ডঃ স্যার মোহাম্মদ ইকবাল তাঁর পাণ্ডিত্য এবং ধর্মীয় বুৎপত্তিতে অত্যন্ত অভিভূত ছিলেন। ১৯০৯ সালে তিনি তাঁকে একটি ধর্মীয় জিজ্ঞাসাবলীর একটি তালিকা পাঠান, যেন তিনি এর সঠিক ব্যাখ্যা পেতে পারেন। তিনি, তাঁকে তার নিজ স্ত্রী তালাকের বিষয়ে একটি ‘ফতোয়া’র জন্য অনুরোধ করেন এবং তিনি সেই ফতোয়া আনুযায়ী কাজ করেন।
উপসংহারে প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আঃ)-এর পুস্তক ‘ফতেহ ইসলাম’ থেকে উল্ল্যেখ করা হয়, আর এ থেকে অধিক গৌরবান্বিত প্রশংসা আর হতে পারে না, কারণ তা মহানবী (সাঃ)-এর এক প্রতিনিধির পক্ষ থেকে করা হয়েছে।
“আমি অবশ্যই অতিশয় আগ্রহের সাথে এক ধর্মীয় ভ্রাতার উল্ল্যেখ করবো যার নামের দ্যুতি তাঁর চমৎকার গুণাবলীর জ্যোতির সাথে মিলে যায়- নূরুদ্দীন অর্থাৎ ধর্মের আলো। আমি ইসলামের জন্যে তাঁর আগ্রহোদ্দীপনা এবং কুরবাণীর ঈর্ষা করি ।
তাঁর উৎসাহ দেখে আমি আল্লাহতা’লার প্রতি শ্রদ্ধাবনত হই যে, তিনি তাঁর পছন্দের বিনয়ী বান্দাকে কিভাবে উন্নীত করে থাকেন”।
তাঁর জীবনের প্রতিটি বিষয়ই আল্লাহতা’লার প্রতি তাঁর ভালোবাসা রঙ্গে রঙ্গীন, তাঁর (আল্লাহতা’লার) প্রতি উৎসর্জনের দ্বারা পরিচালিত । আল্লাহতা’লা জামাতের প্রতিটি সদস্যকে তাঁর প্রদর্শিত পথে পরিচালিত করুন। তিনি একজন খাঁটি আহ্মদীর পরিপূর্ণ দৃষ্টান্ত ছিলেন।
আল্লাহতা’লা তাঁর প্রতি তাঁর সবচেয়ে পছন্দের অনুগ্রহরাজি বর্ষণ করুন।
বাংলা অনুবাদঃ মুহাম্মদ সেলিম খান
Leave a Reply