November 19, 2024, 6:26 am
নবাব সিদ্দীক হাসান খা তার পুস্তক হুজাজুল কেরামার ৩৭৩ পৃষ্ঠায় এবং তার পুত্র সৈয়্যদ নূরুল হাসান খা নিজ পুস্তক ‘ইকতেরাবুস সাআত’ এর ৬৪ পৃষ্ঠায় মাহদী সম্পর্কিত বিশ্বাসকে এভাবে বর্ণনা করেন যা সংক্ষেপে এরূপ যে, “মাহদী প্রকাশিত হবার সাথে সাথে খৃষ্টানদের এভাবে হত্যা করবেন যে, তাদের মধ্যে যারা বেচে যাবে তাদের সরকার ও রাজত্ব চালানোর সাহস থাকবে না এবং রাজত্বের গন্ধ তাদের মস্তিষ্ক হতে দূরীভূত হয়ে যাবে। তারা অপদস্থ হয়ে পলায়ন করবে। তারপর ‘হুজাজুল কেরামার’ই ৩৭৪ পৃষ্ঠার ৮ম লাইনে লেখা আছে “এই বিজয়ের পর মাহ্দী হিন্দুস্থানে আক্রমণ করবেন এবং হিন্দুস্থান জয় করবেন। হিন্দুস্থানের বাদশাহের গলায় শৃঙ্খল পরিয়ে তাকে তার সামনে উপস্থিত করা হবে। এবং সরকারের সকল ধন-সম্পদ ব্যাংক লুট করে নিবেন।” এর চাইতে অধিকতর ব্যাখ্যা ইকতারাবুস সাআত’ পুস্তকের ৬৪ পৃষ্ঠায় এভাবে রয়েছে যা উল্লেখিত পৃষ্ঠা অর্থাৎ ৬৪ পৃষ্ঠার ১৩তম লাইন হতে ১৭তম লাইনে লেখা আছে যে, “হিন্দুস্থানের বাদশাহগণকে গলায় শৃঙ্খল পরিয়ে তার অর্থাৎ মাহ্দীর সামনে আনা হবে । তাদের ধন-ভান্ডার দ্বারা বায়তুল মুকাদ্দসকে সুসজ্জিত করা হবে।”এরপর তিনি নিজের মত প্রকাশ করেন এবং উহার সমর্থনে তার মুখের কথা হলো, “আমি বলছি এখন (হিন্দুস্থানে-অনুবাদক) কোন বাদশাহ্ তো নেই। এই কয়েকজন হিন্দু ও মুসলমান জমিদার আছে। তারাও কোন স্থায়ী প্রশাসক নন বরং তারা নামে মাত্র। এ রাজ্যের বাদশাহ্ ইউরোপীয়। সম্ভবতঃ এই সময় পর্যন্ত অর্থাৎ মাহদীর যুগ পর্যন্ত যথাসম্ভব এরাই এখানকার শাসক থাকবেন। এদেরকেই গ্রেফতার করে মাহ্দীর সামনে নিয়ে যাওয়া হবে।” এর পূর্বে এই ব্যক্তিই লিখে এসেছেন যে, গলায় শৃঙ্খল বেঁধে গ্রেফতার করা হবে।হুজাজুল কেরামাতে লেখা হয়েছে যে, সেই সময় সন্নিকটে এবং সম্ভবতঃ চৌদ্দ শতাব্দীতে এ সব কিছু ঘটে যাবে। অতঃপর “ইকতারাবুস সাআতের” ৬৫ পৃষ্ঠায় লেখা আছে যে, “মাহ্দী খৃষ্টানদের ক্রুশ ভঙ্গ করবে অর্থাৎ তাদের ধর্মের নাম ও নিশানা অবশিষ্ট রাখবে না।” আবার হুজাজুল কেরামার ৩৮১ পৃষ্ঠায় লেখা আছে যে, ঈসা আসমান হতে অবতরণ করে মাহ্দীর মন্ত্রী হবেন এবং বাদশাহ্ হবেন মাহ্দী। হুজাজুল কেরামার ৩৮৩ পৃষ্ঠায় সুসংবাদ দিচ্ছেন যে, মাহ্দীর যুগ সন্নিকটে ।
অতঃপর ৩৮৪ পৃষ্ঠায় লেখা আছে যে, মুসলমানদের এক ফিকা যারা বিশ্বাস করে না যে, মাহ্দী এরূপ মর্যাদা ও ক্ষমতাধর অর্থাৎ গাজী এবং মুজাহিদরুপে আসবে সেই ফির্কা ভ্রান্তিতে রয়েছে। কেননা এই নিদর্শনের সাথে মাহ্দীর প্রকাশিত হওয়া সিহাহ সিত্তাহ্ অর্থাৎ হাদীসের ছয়টি প্রামাণ্য গ্রন্থ হতে প্রমাণিত। হুজাজুল কেরামার ৩৯৫ পৃষ্ঠায় নবাব সিদ্দীক হাসান খা লিখেছেন যে, মাহ্দীর প্রকাশিত হবার সময় অতি নিকটে । সমস্ত চিহ্নাবলী প্রকাশিত হয়েছে এবং ইসলাম ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে। হুজাজুল কেরামার ৪২৪ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেন, ঈসাও মাহ্দীর মত তরবারী দ্বারা ইসলামকে বিস্তার দান করবেন। দু’টি কথাই হবে। হয় হত্যা নতুবা ইসলাম।’আহ্ওয়ালুল আখেরাতে’ পুস্তকের ৩১ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, যে সকল খৃষ্টান ঈমান আনবে না তাদের সকলকে হত্যা করা হবে।
মোট কথা ইহা মুহাম্মদ হুসায়েন এবং তার ঐ দলের ধম-বিশ্বাস যাদেরকে এখন আহলে হাদীস বলে ডাকা হয়। সাধারণ মুসলমান তাদের ওহাবী বলে সম্বোধন করে থাকে। মুহাম্মদ হুসায়েন নিজেকে তাদের নেতা ও প্রবক্তা বলে মনে করে। এই ধর্মীয় বিশ্বাসের উৎস এরা ভুলবশতঃ ঐ সকল হাদীসকে মনে করে যা হাদীসের বিখ্যাত পুস্তক ‘মিশকাত’ নামে খ্যাত-এর ‘বাবুল মালাহামে’ উল্লেখ রয়েছে। আরবীতে ‘মালাহামা’ বড় বড় যুদ্ধকে বলা হয়। তারা মনে করে এ সকল যুদ্ধ মাহদী খৃষ্টান ও অন্যান্যদের সাথে করবেন। “মিশকাতের’ ব্যাখ্যা ‘মাযাহেরে হাক্ক’ গ্রন্থের চতুর্থ খন্ডের ৩৩১ পৃষ্ঠা থেকে উক্ত অধ্যায়টি শুরু হয়। কিন্তু পরিতাপ এই যে, তারা এ সকল হাদীসকে বুঝতে বড়ই ভুল করেছে। মোট কথা মুহাম্মদ হুসায়েন ও ‘ তার দল যাদেরকে আহলে হাদীস বলা হয় তারা আগমনকারী মাহ্দী সম্বন্ধে এ বিশ্বাস করে। এসব লোক যে কত ভয়ঙ্কর, শান্তি ভঙ্গের ও উত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপাদান নিজেদের মধ্যে ধারণ করে তা লেখার অবকাশ রাখে না। এদের তুলনায় আমার ও আমার জামাতের বিশ্বাস নিচে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
মাহদী সম্বন্ধে আমার ও আমার জামাতের বিশ্বাস এই যে, মাহ্দীর আগমন সংক্রান্ত এ ধরনের হাদীসসমূহ কোন মতেই আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমার মতে এগুলোর উপর তিন ধরনের আপত্তি আছে। অন্য কথায় এগুলি তিন শ্রেণীর বাইরে নয়ঃ (১) প্রথমতঃ এসব হাদীস জাল, মওযু (মনগড়া) অপ্রামাণ্য ও ভ্রান্ত এবং এদের বর্ণনাকারীদের উপর অবিশ্বস্ততা ও মিথ্যা বলার অপবাদ রয়েছে। কোন ধার্মিক মুসলমান এদের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে না। (২) দ্বিতীয়তঃ এসব হাদীসে কিছু রয়েছে যেগুলো যয়ীফ (দুর্বল) ও মযরূহ্ (যে হাদীসে বর্ণনাকারীর চরিত্রের উপর আপত্তি উত্থাপিত হয়) হাদীসগুলো পরস্পর বিরোধী হওয়ার কারণে এগুলো আস্থার মানদন্ডের ধোপে টেকে না । হাদীসের বিখ্যাত ইমামগণ – হয় এগুলোর একেবারেই উল্লেখ করেন নি অথবা আপত্তি ও অবিশ্বাসের সাথে উল্লেখ করেছেন। তারা এ রেওয়ায়াতের সত্যায়ন করেন নি অর্থাৎ বর্ণনাকারীদের সততা ও বিশ্বস্ততার সাক্ষ্য দেন নি। (৩) তৃতীয় প্রকারের হাদীসগুলো বিভিন্ন সনদে তাদের প্রামাণিকার সন্ধান তো পাওয়া যায় কিন্তু এগুলো হয়তো পূর্বের যুগে পূর্ণ হয়ে গেছে এবং ওগুলোতে বর্ণিত যুদ্ধগুলো বহু পূর্বেই সংঘটিত হয়ে গেছে। এখন সেগুলোর জন্য অপেক্ষার সম্ভাব্য কোন অবস্থা অবশিষ্ট নেই, অথবা ওগুলোতে বাহ্যিক খেলাফত ও বাহ্যিক যুদ্ধের কোন উল্লেখ নেই। শুধুমাত্র এক মাহ্দী অর্থাৎ এক হেদায়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তির আগমনের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। এবং ইঙ্গিতে বরং পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে যে, তার কোন বাহ্যিক রাজত্ব ও বাহ্যিক খেলাফত হবে না। সে না যুদ্ধ করবে আর না-ই রক্ত ঝরাবে। তার কোন সৈন্যদল থাকবে না। বরং আধ্যাত্মিকতা ও আত্মিক দৃষ্টি দ্বারা হৃদয়গুলিতে আবার ঈমান প্রতিষ্ঠিত করবেন। যেমন কিনা হাদীসে আছে ‘লা মাহ্দীয়্যা ইল্লা ঈসা । ইহা ইবনে মাজার প্রসিদ্ধ গ্রন্থে আছে এবং হাকীম প্রণীত হাদীস গ্রন্থ ‘মুসতাদরেকে’ আনাস বিন মালেক হতে বর্ণিত হয়েছে।
এই বর্ণনা মুহাম্মদ বিন খালিদ জুদী আবান বিন সালেহ হাসান বাসরী হতে, হাসান বাসরী আনাস বিন মালেক হতে এবং আনাস বিন মালেক জনাব রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম হতে রেওয়ায়াত করেছেন। এই হাদীসের অর্থ হলো, ঐ ব্যক্তি ব্যতীত যিনি ঈসার প্রকৃতি ও চরিত্রে আগমন করবেন, অন্য মাহ্দী হবেন না। অর্থাৎ তিনিই প্রতিশ্রুত মসীহ্ হবেন এবং তিনিই মাহদী হবেন, যিনি হযরত ঈসা (আঃ) এর প্রকৃতি, চরিত্র ও তার শিক্ষা পদ্ধতিতে আগমন করবেন অর্থাৎ মন্দের মুকাবেলায় বল প্রয়োগ করবেন না ও যুদ্ধ করবেন না বরং পবিত্র আদর্শ ও ঐশী নিদর্শন দ্বারা হেদায়াতকে বিস্তার দিবেন। এবং এই হাদীসের সমর্থনে আরেকটি হাদীস রয়েছে যা ইমাম বুখারী স্বীয় সহীহ্ বুখারীতে লিপিবদ্ধ করেছেন। যাতে এই কথা রয়েছে, ‘ইয়াযাউল হারবা’ অর্থাৎ ঐ মাহ্দী যার নাম প্রতিশ্রুত মসীহ্ তিনি ধর্মীয় যুদ্ধকে সম্পূর্ণরূপে রহিত করে দিবেন। তার এই নির্দেশ হবে যে, ধর্মের জন্য যুদ্ধ করো না, বরং ধর্মকে সত্যের জ্যোতিঃ নৈতিক মু’জিযা ও খোদার নৈকট্যের নিদর্শনাবলী দ্বারা বিস্তার দাও।
সুতরাং আমি সত্য সত্য বলছি, যে ব্যক্তি এ সময়ে খোদার ধর্মের জন্যে যুদ্ধ করছে অথবা যোদ্ধাদেরকে সমর্থন করে অথবা প্রকাশ্য বা গোপনে এরূপ পরামর্শ দেয় অথবা মনে এমন ইচ্ছা আকাঙক্ষা পোষণ করে সে খোদা ও রসূলের অবাধ্য এবং খোদা ও রসূলের জরুরী বিধিবদ্ধ নির্দেশ-উপদেশ ও শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখাসমূহ এবং অবশ্য করণীয় কর্তব্যসমূহের বাইরে চলে গেছে । আমি এখন আমাদের সদয় সরকারকে জানাচ্ছি যে, হেদায়াত প্রাপ্ত এবং মসীহ (আঃ)-এর চরিত্রের উপর পরিচালিত সেই প্রতিশ্রুত মসীহ্ আমিই। প্রত্যেকের উচিত আমাকে ঐ সকল চরিত্রে নিরীক্ষণ করে এবং নিজ হৃদয় হতে মন্দ ধারণা দূর করে নেয়। আমার বিশ বছরব্যাপী শিক্ষা, যা বারাহীনে আহমদীয়া হতে শুরু হয়ে রাযে হাকীকাতা পুস্তক প্রণয়ন পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে, যদি কেউ এগুলোকে সাক্ষী হিসেবে নেয় তবে এগুলো আমার অভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতার সব চাইতে বড় সাক্ষী হিসেবে পাবে। আমার কাছে প্রমাণ রয়েছে যে, আমি এ গ্রন্থাবলী আরব, ইউরোপ, সিরিয়া, কাবুল ও অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে দিয়েছি। আমি এ বিষয়কে নির্ঘাৎ অস্বীকার করি যে, ইসলামের পক্ষে ধর্মীয় যুদ্ধের জন্যে মসীহ্ আকাশ হতে অবতরণ করবেন ও সে সময়ে ফাতেমার বংশধর হতে কোন ব্যক্তি মাহদি নামের বাদশাহ হবেন। এবং দু’জনে মিলে রক্তক্ষরণ শুরু করবেন। আল্লাহ্তাআলা আমাকে সুনিশ্চিৎ জানিয়েছেন হযরত মসীহ্ (আঃ) বহু পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং কাশ্মীরের খানইয়ার মহল্লায় তার মাজার (সমাধি) মজুদ আছে। সুতরাং যেভাবে মসীহর আকাশ হতে অবতীর্ণ হওয়া মিথ্যা প্রমাণিত সেভাবেই কোন যুদ্ধবাজ মাহদীর আগমন বাতিল সাব্যস্ত। এখন যে ব্যক্তি সত্য-পিপাসু সে যেন ইহা গ্রহণ করে।
– বিনীত লেখকমির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আঃ)[পুস্তক:হাকীকাতুল মাহদী(বঙ্গানুবাদ), পৃষ্ঠা:৭-১০]
Leave a Reply