November 20, 2024, 2:40 pm
জন্মিলে মরিতে হয় এটি একটি চিরসত্য কথা। কিন্তু অতিভক্তি বা আত্মপ্রতারণায় মগ্ন কিছু মানুষ হযরত ঈসা (আ.)-এর জীবন ও মৃত্যু উভয়টিকে বিতর্কিত করে রেখেছে। এভাবে শির্ক ও পৌত্তলিকতার সর্বগ্রাসী দ্বার উম্মোচন করেছে এবং পৃথিবীর কান্ডজ্ঞানহীন বহু মানব প্রজন্মকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে ঠেলে দিয়েছে। কেননা, একজন মানুষকে যদি স্বাভাবিক জন্ম ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বে মনে করা হয় তাহলে তাকে অতিমানবের স্থান দেয়া হলো; আর অজ্ঞ প্রজন্ম তখন সর্বশক্তিমান খোদাকে ছেড়ে এমন মানুষকেই খোদা মনে করে বসে; কেননা তাকে যে হাতের কাছে এবং দৃষ্টিসীমার মাঝে পায়। আর হৃদয় বিদারক হলেও সত্য যে, আজকের পৃথিবী এই পাপেই নিমজ্জিত। কিন্তু পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা’লা হযরত ঈসা (আ.)-কে মৃত ঘোষণা করেছেন আর আহ্মদীয়া মুসলিম জামা’ত-এর পবিত্র প্রতিষ্ঠাতা, হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও ইমাম মাহদী, ঐশী জ্ঞানের ভিত্তিতে পবিত্র কুরআনের আলোকে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করেছেন যে, আল্লাহ্র রসূল ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) ইন্তেকাল করেছেন। হযরত ইমাম মাহ্দী ও মসীহ্ মওউদ (আ.) তাঁর বিখ্যাত পুস্তক “ইযালায়ে আওহাম”-এ কুরআনের ৩০টি স্থান থেকে আয়াত বা আয়াতাংশ উদ্ধৃত করে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.)-এর মৃত্যু প্রমাণ করেছেন। নিম্নে উক্ত পুস্তকের আলোকে বিভিন্ন আয়াত বা আয়াতাংশ সমূহের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ পাঠকের সম্মূখে উপস্থাপন করা হলো। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আহ্মদীয়া মুসলিম জামা’ত বিসমিল্লাহ্কে প্রত্যেক সূরার প্রথম আয়াত হিসেবে গণ্য করে।
اِذْ قَالَ اللّٰهُ يٰعِيْسٰىۤ اِنِّىْ مُتَوَفِّيْكَ وَرَافِعُكَ اِلَىَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا وَجَاعِلُ الَّذِيْنَ اتَّبَعُوْكَ فَوْقَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْۤا اِلٰى يَوْمِ الْقِيٰمَةِۚ ثُمَّ اِلَىَّ مَرْجِعُكُمْ فَاَحْكُمُ بَيْنَكُمْ فِيْمَا كُنْتُمْ فِيْهِ تَخْتَلِفُوْنَ
অর্থ: (স্মরণ কর) আল্লাহ্ যখন বললেন, ‘হে ঈসা! নিশ্চয় আমিই তোমাকে (স্বাভাবিক) মৃত্যু দিব এবং আমার দিকে তোমাকে উন্নীত করবো আর যারা অস্বীকার করেছে তাদের (অপবাদ) থেকে তোমাকে পবিত্র সাব্যস্ত করবো এবং অস্বীকারকারীদের ওপর তোমার অনুসারীদের কিয়ামত দিবস পর্যন্ত প্রাধান্য দান করবো। এরপর আমারই দিকে হবে তোমাদের প্রত্যাবর্তণ। তখন আমি তোমাদের মাঝে সেসব বিষয়ে মিমাংসা করবো যা নিয়ে তোমরা মতভেদ করে আসছিলে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: এ আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা হযরত ঈসা (আ.)-কে চারটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রথমটি তাঁর মৃত্যু, দ্বিতীয়টি তাঁর রা’ফা বা খোদার অসাধারণ নৈকট্য বা মৃত্যুর পর তাঁর আত্মিক উন্নতি, তৃতীয়টি কাফিরদের অপবাদ থেকে তাঁকে পবিত্র ঘোষণা করা, তাঁর পবিত্রতা প্রমাণ করা এবং অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে তাঁর অনুসারীদের প্রাধান্য লাভ। এ চারটি প্রতিশ্রুতি খোদা তা’লা যেভাবে বলেছেন সেই ধারাবাহিকতায় পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। খোদা তা’লা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন যে, প্রথমে তাঁর মৃত্যু হবে, আর প্রকৃতপক্ষে তাই হয়েছে। কেউ কেউ বলে, এ আয়াতে যেই ‘মুতাওয়াফ্ফীকা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এর অর্থ হলো আমি তোমাকে পুরা পুরা উঠাবে বা পুরা পুরা গ্রহণ করবো। কিন্তু, এই অর্থ করার কোন সুযোগ নেই, কারণ রসুল করীম (সা.)-এর সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস স্বয়ং বলেছেন যে, ‘মুতাওয়াফ্ফীকা’ অর্থ ‘মুমীতুকা’ অর্থাৎ আমি তোমাকে মৃত্যু দেব। সুতরাং, আয়াতে উল্লেখিত বিষয়াবলীর ধারাবাহিকতায় প্রথমে তাঁর মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে, আর কার্যত তাই হয়েছে এবং হযরত ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু ঘটেছে।
بَل رَّفَعَهُ اللّٰهُ اِلَيْهِؕ وَكَانَ اللّٰهُ عَزِيْزًا حَكِيْمًا
অর্থ: বরং আল্লাহ্ তাকে নিজের দিকে উন্নীত করেছেন। আর আল্লাহ্ মহা পরাক্রমশালী (ও) পরম প্রজ্ঞাময়।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: ইহুদীরা তাঁকে অভিশপ্ত আখ্যায়িত করার মানসে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু, খোদা তা’লা বলেন, এমন নয় বরং আল্লাহ্ তাঁর রাফা করেছেন’ অর্থাৎ তাঁর সম্মানজনক মৃত্যু হয়েছে, অভিশপ্ত নয়। রাফা শব্দ সম্মানজনক মৃত্যুর জন্যই ব্যবহার করা হয়। যেমন, হযরত ইদ্রিস (আ.)-এর জন্য আল্লাহ্ তা’লা পবিত্র কুরআনে এই শব্দ মৃত্যুর অর্থে ব্যবহার করেছেন। হাদীসেও মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের পর সাহাবাদের উক্তি আছে যে, আল্লাহ্ স্বীয় নবীর রাফা করেছেন, অর্থাৎ তিনি মৃত্যুর পর খোদার সন্নিধানে সম্মানজনক স্থানে আসীন হয়েছেন। রাফা শব্দ পদমর্যাদায় উন্নতির জন্য ব্যবহৃত হয়, দেহ আকাশে যাওয়ার জন্য নয়। এর প্রমাণ হলো সূরা মুজাদিলার আয়াত নং ১২, যেমন আল্লাহ্ তা’লা বলেন: يَرْفَعِ اللّٰهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْۙ وَالَّذِيْنَ اُوْتُوْا الْعِلْمَ دَرَجٰتٍؕ অর্থাৎ, তোমাদের মধ্য হতে যারা ঈমান আনে এবং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে আল্লাহ্ তাদের পদমর্যাদার রা’ফা (উন্নীত) করেন, অর্থাৎ তাদের পদমর্যাদা উন্নীত হয়। “রাফা”-র ফলে তাদের দেহ আকাশে যায় না।
وَاِذْ قَالَ اللّٰهُ يٰعِيْسَى ابْنَ مَرْيَمَ ءَاَنْتَ قُلْتَ لِلنَّاسِ اتَّخِذُوْنِىْ وَاُمِّىَ اِلٰهَيْنِ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِؕ قَالَ سُبْحٰنَكَ مَا يَكُوْنُ لِىْۤ اَنْ اَقُوْلَ مَا لَـيْسَ لِىْ بِحَقٍّؕ اِنْ كُنْتُ قُلْتُهٗ فَقَدْ عَلِمْتَهٗؕ تَعْلَمُ مَا فِىْ نَفْسِىْ وَلَاۤ اَعْلَمُ مَا فِىْ نَفْسِكَؕ اِنَّكَ اَنْتَ عَلّٰمُ الْغُيُوْبِ
مَا قُلْتُ لَهُمْ اِلَّا مَاۤ اَمَرْتَنِىْ بِهٖۤ اَنِ اعْبُدُوا اللّٰهَ رَبِّىْ وَرَبَّكُمْۚ وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيْدًا مَّا دُمْتُ فِيْهِمْۚ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِىْ كُنْتَ اَنْتَ الرَّقِيْبَ عَلَيْهِمْؕ وَاَنْتَ عَلٰى كُلِّ شَىْءٍ شَهِيْدٌ
অর্থ: সে সময়কে স্মরণ কর! যখন আল্লাহ্ তা’লা ঈসা (আ.)-কে বলেছেন, তুমি কি মানুষকে বলেছিলে যে, আল্লাহ্কে পরিত্যাগ করে আমাকে এবং আমার মাকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ কর। সে বলল, যা বলার আমার অধিকার নেই তা আমি কিভাবে বলতে পারি। আর আমি যদি বলতাম, তুমি তা নিশ্চয়ই জানতে। আমার হৃদয়ে কি আছে তা তুমি সম্যক অবগত আর তোমার অন্তরে যা আছে তা আমি জানিনা।
তুমি যে আদেশ আমাকে দিয়েছিলে আমি তাদেরকে কেবল তা-ই বলেছি, অর্থাৎ ‘তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত কর, যিনি আমারও প্রভু-প্রতিপালক এবং তোমাদেরও । আর যতদিন আমি তাদের মাঝে ছিলাম আমি তাদের পর্যবেক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক ছিলাম। কিন্তু তুমি যখন আমাকে মৃত্যু (তাওয়াফ্ফাইতানী) দিলে তখন একমাত্র তুমিই তাদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলে। আর সবকিছুর উপর তোমার সর্বব্যাপি দৃষ্টি রয়েছে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: এই আয়াতে খোদা তা’লা খ্রিষ্টান জাতির ত্রিত্ববাদে লিপ্ত হওয়ার বিষয়ে হযরত ঈসাকে প্রশ্ন করেছেন। হযরত ঈসা বলছেন, যখন তুমি আমার তাওয়াফ্ফা করলে, অর্থাৎ যখন আমায় মৃত্যু দিলে, তখন থেকে তাদের বিষয়ে আমি আর কিছু জানিনা। কুরআন ও হাদীসে সর্বত্র তাওয়াফ্ফা শব্দ মৃত্যু বা রূহ কবজ করার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কেউ কেউ মানুষকে প্রতারিত করার জন্য বলে যে, এখানে ‘তাওয়াফফী’ শব্দ উপরে তুলে নেয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে; কিন্তু একথা সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন। কথার কথা, যদি আমরা তাদের যুক্তি মেনেও নিই, তবুও এই আয়াত অনুসারে হযরত ঈসা (আ.) কিয়ামতের পূর্বে আর কখনও পৃথিবীতে আসতে পারেন না; কেননা; কিয়ামতের পূর্বে যদি আসেন তাহলে নিশ্চয় নিজ জাতিকে ত্রিত্ববাদে নিমজ্জিত দেখতে পাবেন। আর এমন পরিস্থিতিতে খোদার সামনে জাতির বিভ্রান্তি সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেন না।
وَاِنْ مِّنْ اَهْلِ الْكِتٰبِ اِلَّا لَيُؤْمِنَنَّ بِهٖ قَبْلَ مَوْتِهٖۚ وَيَوْمَ الْقِيٰمَةِ يَكُوْنُ عَلَيْهِمْ شَهِيْدًا
অর্থ: আর আহ্লে কিতাবের মাঝে এমন (কোন গোত্র বা দল) নেই যারা তাঁর (অর্থাৎ ঈসার) মৃত্যুর আগে তাঁর প্রতি ঈমান আনবে না। আর সে (অর্থাৎ ঈসা) কিয়ামত দিবসে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হবে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: এই আয়াতের একটি অর্থ করা যেতে পারে, আহলে কিতাবীদের প্রত্যেকেই অর্থাৎ ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা নিজ নিজ মৃত্যুর পূর্বে স্ব-স্ব ধারণানুযায়ী ক্রুশীয় ঘটনার প্রতি ঈমান আনবে। অর্থাৎ ইহুদীরা এই বিশ্বাস নিয়ে মরবে যে, আমরা ঈসাকে ক্রুশে মেরে অভিশপ্ত প্রমাণ করেছি আর খ্রিষ্টানরা এই বিশ্বাস নিয়ে বিদায় নিবে যে, ঈসা (আ.) মানব জাতির পাপ বিমোচনকল্পে ক্রুশে প্রাণ দিয়েছেন।
আবার কেউ কেউ বলে যে, হযরত ঈসা যে জীবিত এই আয়াত হচ্ছে তার প্রমাণ; অর্থাৎ তিনি যখন পৃথিবীতে আসবেন – সমস্ত আহলে কিতাব তাঁর প্রতি ঈমান আনবে। কিন্তু একথা সঠিক নয়, কেননা হাদীসে আছে যে, দাজ্জালের সাথে ৭০,০০০ আহ্লে কিতাব যোগ দেবে, আর সে নিজেও আহ্লে কিতাবের অন্তর্গত হবে। সে মসীহ্র প্রতি ঈমান আনবে না এবং কাফির অবস্থাতেই মারা যাবে।
অতএব এ যুক্তি ভ্রান্ত, পক্ষান্তরে এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, হযরত ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করেছেন। প্রধাণতঃ স্মরণ রাখতে হবে, ইহুদী খ্রিষ্টানদের কাছে হযরত ঈসা (আ.)-এর ক্রুশীয় মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিৎ কোন প্রমাণ নেই। ইহুদীরা বলছে, তিনি অভিশপ্ত হিসেবে মারা গেছেন; আর খ্রিষ্টানরা বলে যে, হযরত ঈসা (আ.) মানুষের মুক্তির জন্য রক্ত দিয়েছেন এবং ক্রুশীয় অভিশপ্ত মৃত্যুকে বরণ করেছেন। অপরদিকে আল্লাহ্ বলছেন, না তারা তাঁকে হত্যাও করতে পারেনি আর ক্রুশবিদ্ধ করেও মারতে পারেনি; বরং ঈসার মৃত্যু সম্পর্কে আহ্লে কিতাব ঘোরতর সন্দেহে নিপতিত।
সকল আহ্লে কিতাব নিঃসন্দেহে একমত যে, হযরত ঈসার মৃত্যু সম্পর্কে তাদের নিশ্চিত কোন জ্ঞান নেই। সকল আহ্লে কিতাব স্বীয় মৃত্যুর পূর্বে অবশ্যই এ কথার উপর ঈমান আনবে যে, হযরত ঈসার ক্রুশে নিহত হওয়া সম্পর্কে তারা সন্দিহান। তারা তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করেও নিহত করতে পারেনি আর হত্যাও করতে পারেনি; আর যদি এ দু’টোর কোনটিই না হয়, তাহলে তৃতীয়টি অর্থাৎ স্বাভাবিক সম্মানজনক মৃত্যুর উপর ঈমান আনা তাদের জন্য আবশ্যক।
আহ্লে কিতাবের প্রত্যেক ব্যক্তি ঈমান না আনলেও প্রতিনিধিত্বমূলকভাবে হলেও আহ্লে কিতাবের প্রত্যেক গোত্রের ঈমান এমনই হবে। এই সত্য কথাটি খোদা তা’লা পবিত্র কুরআনে এভাবে বর্ণনা করেছেন بَل رَّفَعَهُ اللّٰهُ اِلَيْهِؕ وَكَانَ اللّٰهُ عَزِيْزًا حَكِيْمًا
مَا الْمَسِيْحُ ابْنُ مَرْيَمَ اِلَّا رَسُوْلٌۚ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُؕ وَاُمُّهٗ صِدِّيْقَةٌ ؕ كَانَا يَاْكُلٰنِ الطَّعَامَؕ اُنْظُرْ كَيْفَ نُبَيِّنُ لَهُمُ الْاٰيٰتِ ثُمَّ انْظُرْ اَنّٰى يُؤْفَكُوْنَ
অর্থ: মরিয়মের পুত্র মসীহ্ কেবল একজন রসূল। তাঁর পূর্বে সব রসূল অবশ্যই গত হয়ে গেছেন। তাঁর মা ছিল একজন সিদ্দিকাহ্ (সত্যবাদিনী)। তাঁরা উভয়েই খাবার খেত। দেখ! কিভাবে আমরা তাদের জন্য নিদর্শনাবলী সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করছি। আবার দেখ! তাদেরকে কিভাবে বিপথগামী করা হচ্ছে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: এই আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ ‘কানা ইয়াকুলান’ এর অর্থ হলো তাঁরা উভয়ই অতীতে খাবার খেতেন। জানা কথা, হযরত মরিয়ম মৃত্যুর কারণে এখন আর খাবার খান না। হযরত ঈসাকেও খোদা তা’লা একই শব্দের অধীনে এনেছেন, তাঁর জন্য পৃথক কোন শব্দ ব্যবহার করেন নি। তাই এটি সুস্পষ্ট যে, হযরত ঈসা (আ.) ও ইন্তেকাল করেছেন। কেউ কেউ বলে যে, তিনি যদি বিনা পিতায় জন্ম নিতে পারেন, তাহলে খাবার না খেয়েও জীবিত থাকতে পারেন; এমন লোকদের জন্য দুঃসংবাদ হলো, পবিত্র কুরআনের সূরা আম্বিয়ায় নবীদের নাম উল্লেখের পর খোদা তা’লা বলেন, “আমি তাঁদের এমন কোন শরীর বা দেহ দান করিনি যা খাবার না খেলেও টিকে থাকতে পারে”। তাই বুঝা গেল যে, হযরত ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করেছেন।
وَمَا جَعَلْنٰهُمْ جَسَدًا لَّا يَاْكُلُوْنَ الطَّعَامَ وَمَا كَانُوْا خٰلِدِيْنَ
অর্থ: আর আমরা তাদের এমন দেহবিশিষ্ট করে সৃষ্টি করিনি, যারা খাবার খেত না আর তারা চিরকাল বেঁচেও থাকতো না।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা তাঁর একটি অমোঘ নিয়মের উল্লেখ করেছেন। আর তা হলো, নবী মাত্রই জীবন ধারণের জন্য খাবার খেয়ে থাকেন আর তাঁরা অস্বাভাবিক দীর্ঘজীবন লাভ করেন না। ‘খালেদীন’ শব্দটি চিরস্থায়ী ও দীর্ঘস্থায়ী উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ নিয়মানুযায়ী যদি কোন নবী সম্বন্ধে কুরআন সাক্ষ্য প্রদান করে বলে, তিনি অতীতে খাবার খেতেন এখন আর খান না তাহলে সুনিশ্চিৎভাবে প্রমাণ হবে যে, সেই নবী আর জীবিত নেই। হযরত ঈসা (আ.) সম্বন্ধে এ কথাই আল্লাহ্ তা’লা সূরা মায়েদার ৭৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন। অতএব হযরত ঈসা (আ.) নিশ্চিতভাবে মারা গেছেন।
وَمَا مُحَمَّدٌ اِلَّا رَسُوْلٌ ۚ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُؕ اَفَا۟يِٕنْ مَّاتَ اَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلٰٓى اَعْقَابِكُمْؕ وَمَنْ يَّنْقَلِبْ عَلٰى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَّضُرَّ اللّٰهَ شَيْـًٔـاؕ وَسَيَجْزِىْ اللّٰهُ الشّٰكِرِيْنَ
অর্থ: এবং মুহাম্মদ একজন রসূল ছাড়া আর কিছুই নয়। নিশ্চই তাঁর পূর্বের সব রসূল গত হয়ে গেছে। অতএব সেও যদি মারা যায় বা নিহত হয় তোমরা কি তবে তোমাদের পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে? আর যে ব্যক্তি তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায় সে কখনো আল্লাহ্র কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। আর আল্লাহ্ কৃতজ্ঞদের অবশ্যই পুরস্কৃত করবেন।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: এই আয়াতে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী সব রসূল গত হয়েছেন। একই রীতি অনুসারে যদি হযরত মুহাম্মদ (সা.) গত হয়ে যান তাহলে আশ্চর্যের কি আছে?
মহানবী (সা.) সম্পর্কে কেউ কেউ ধরে নিয়েছিলেন যে, তিনি ইন্তেকাল করতে পারেন না। তাই তাঁর ইন্তেকালের পর কারো কারো পক্ষে তা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। হুযুর (সা.)-এর ইন্তেকালের সময় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মদিনার বাহিরে ছিলেন। ফিরে এসে তিনি এই অবস্থা দেখেন; সর্বপ্রথম মহানবী (সা.)-এর পবিত্র ললাটে চুমু খেয়ে মসজিদে নববীতে গিয়ে সাহাবাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেন। আর বলেন যে,
“তোমাদের মধ্য হতে যারা খোদার ইবাদত করে তারা নিশ্চিত থাকতে পারে যে, তিনি চিরঞ্জীব; তিনি কখনও ইন্তেকাল করেন না। অপরদিকে যারা মুহাম্মদ (সা.)-এর ইবাদত করতো তাদের জানা উচিত যে, তিনি ইন্তেকাল করেছেন”।
এরপর তিনি পবিত্র কুরআনের এই আয়াত পাঠ করেন, যার মাধ্যমে সাহাবারা বুঝতে পারেন যে, মহানবী (সা.) ইন্তেকাল করেছেন এবং তাঁর পূর্বের নবীরাও। হযরত উমর (রা.) বলেন,
“হযরত আবু বকর যখন এই আয়াত পাঠ করলেন আমার এমন মনে হলো যেন কুরআনের এই আয়াতটি প্রথমবার নাযিল হয়েছে এবং আমার পদযুগল দুর্বল হয়ে যায় আর আমার হাত থেকে তরবারী খসে পড়ে”।
সকল সাহাবী নিশ্চিত হলেন যে, এই আয়াত মোতাবেক মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইন্তেকাল করেছেন। এই আয়াতের মাধ্যমে সাহাবারা নিশ্চিত হলেন যে, মহানবী (সা.) সহ পূর্বের সকল রসূল ইহধাম ত্যাগ করেছেন। কোন সাহাবী উচ্চবাচ্য করেন নি যে, না হযরত ঈসা (আ.) আকাশে আছেন। বুখারী শরীফে সবিস্তারে এই ঘটনার উল্লেখ আছে।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পরপরই হযরত ঈসা (আ.) সহ সকল নবী-রসূলের মৃত্যুর বিষয়ে মুসলমানরা ইজমা বা ঐকমত্যে পৌঁছেছেন আর এটিই ইসলামের প্রথম ইজমা।
وَمَا جَعَلْنَا لِبَشَرٍ مِّنْ قَبْلِكَ الْخُـلْدَؕ اَفَا۟ئِن مِّتَّ فَهُمُ الْخٰـلِدُوْنَ
অর্থ: আর আমরা তোমার পূর্বে কোন মানুষকে চিরস্থায়ী (জীবন) দান করিনি। অতএব তুমি মারা গেলে তারা কি চিরকাল (বেঁচে) থাকবে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: এই আয়াতের অর্থ হলো, কোন মানুষ মৃত্যুর বিধানের বাহিরে নয়। অভিধানে ‘খুল্দ্’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে, সর্বদা একই অবস্থায় থাকা বা চির সবুজ থাকা। এ আয়াত অনুসারে ‘খুল্দ্’ কাউকে দেয়া হয়নি। কালের বা যুগের প্রভাবে সকলেই মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। হযরত ঈসা (আ.) ও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নন। মহানবী (সা.) হলেন সবচেয়ে বড় ও কল্যাণকর নবী, অস্বাভাবিক দীর্ঘ জীবন বা ‘খুল্দ্’ যদি তাঁকে প্রদান না করা হয় তাহলে অন্য কাউকে প্রদান করা – কি করে সিদ্ধ হতে পারে? অতএব এই আয়াতও হযরত ঈসার স্বাভাবিক পরিণতির সাক্ষ্য বহন করে।
تِلْكَ اُمَّةٌ قَدْ خَلَتْۚ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَلَـكُمْ مَّا كَسَبْتُمْۚ وَلَا تُسْـَٔـلُوْنَ عَمَّا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ
অর্থ: এ হলো সেই উম্মত যারা গত হয়ে গেছে। তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের এবং তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের। আর তাদের কৃতকর্মের জন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: অর্থাৎ ইতোপূর্বে যত নবী ছিলেন তাঁরা একটি উম্মত বা সম্প্রদায় ছিলেন, যাদের সকলেই ইন্তেকাল করেছেন। পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে কয়েকজন নবীর উল্লেখের পর আল্লাহ্ তা’লা এ আয়াতে তাঁদের মৃত্যুর উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, নবী-রসূলরাও স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যুর বিধানের ঊর্ধ্বে নন। এই মৃত্যুর বিষয়টি বুঝানোর জন্য এখানে ‘খালাত’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সূরা আলে ইমরানের ১৪৫ নম্বর আয়াতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) সহ সকল রসূলের ইন্তেকালের বিষয়টি বুঝানোর জন্য একই ‘খালাত’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অতএব সকল নবীদের মাঝে হযরত ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুও সুপ্রমাণিত।
وَجَعَلَنِىْ مُبَارَكًا اَيْنَ مَا كُنْتُ وَاَوْصٰنِىْ بِالصَّلٰوةِ وَالزَّكٰوةِ مَا دُمْتُ حَيًّا
অর্থ: আর আমি যতদিন জীবিত থাকি তিনি আমাকে নামায ও যাকাতের (আদায় করার) তাগিদ দিয়েছেন। আর আমি যেখানেই থাকি না কেন – তিনি আমাকে কল্যাণমন্ডিত করেছেন।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: যারা হযরত ঈসাকে জীবিত বলে বিশ্বাস করে তাদেরকে এই আয়াত প্রশ্নবানে জর্জরিত করে। আয়াত বলে, তিনি যদি জীবিত থাকেন তাহলে তাঁকে দু’টো কাজ অর্থাৎ নামায পড়া ও যাকাত প্রদানের কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। প্রশ্ন হলো, তিনি আকাশে কোন্ শরিয়ত মোতাবেক নামায পড়েন ও যাকাত প্রদান করেন? কুরআন বলে যে, তিনি হলেন বনী ঈস্রাইলের রসূল – তাই নিঃসন্দেহে তাঁকে ইঞ্জীলের রীতি মোতাবেক নামায পড়তে হবে। আবার প্রশ্ন দাঁড়াবে যে, তিনি যাকাত কাকে দেন? আকাশে কি এমন মানুষও আছেন যারা দরিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছেন? আরও প্রশ্ন হলো, আকাশে তিনি যখন খ্রিষ্টানদের রীতি মোতাবেক নামায পড়েন তখন হযরত ইয়াহিয়া তাঁর পাশে কি নির্বিকার পড়ে থাকেন! তিনিও তো আকাশে জীবিত; কেননা মে’রাজের রাতে মহানবী (সা.) তাঁকেও ঈসা (আ.)-এর সাথেই দেখেছেন। তিনি যদি আকাশে ইসলামী রীতি মোতাবেক নামায পড়েন তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াবে কে তাঁকে ইসলামী নামায শিখালো? যদি আল্লাহ্ শিখিয়ে থাকেন তাহলে বুঝা গেল যে, খোদা তাঁর প্রতি ওহী করেছেন। সেক্ষেত্রে এটি সাব্যস্ত্য হবে যে, ওহীর দ্বার এখনও খোলা আছে। এছাড়া যখন হযরত ঈসা (আ.) পৃথিবীতে আসবেন তখন কি কুরআনের এই আয়াতের পরিপন্থী কাজ করবেন? কেননা এই আয়াতে, যতদিন তাঁর প্রাণ থাকবে ততদিন তাকে ইঞ্জীলের রীতি মোতাবেক নামায পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে? তাই সহজ ও সরল এবং সত্য কথা হলো, হযরত ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করেছেন।
وَالسَّلٰمُ عَلَىَّ يَوْمَ وُلِدْتُّ وَيَوْمَ اَمُوْتُ وَيَوْمَ اُبْعَثُ حَيًّا
অর্থ: আর আমার প্রতি শান্তি (বর্ষিত হয়েছিল) যেদিন আমি জন্মেছিলাম। যেদিন আমি মারা যাবো এবং যেদিন আমাকে জীবিত করে উত্থিত করা হবে (সেদিনও আমার উপর শান্তি বর্ষিত হবে)।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: এই আয়াত অনুসারে হযরত ঈসার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা শুধু তিনটিই। যদি আকাশে স্বশরীরে যাওয়া এবং আকাশ থেকে নাযিল হবার বিষয়টি সঠিক হতো, তাহলে নিশ্চয় তা এই আয়াতে উল্লেখ করা হতো। যদি এমন কথা সঠিক হতো, তাহলে খোদা তা’লা অবশ্যই একে তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করতেন। কাজেই, বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি আকাশেও যাননি আর আকাশ থেকে আসবেনও না।
يٰۤاَيُّهَا النَّاسُ اِنْ كُنْتُمْ فِىْ رَيْبٍ مِّنَ الْبَعْثِ فَاِنَّا خَلَقْنٰكُمْ مِّنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُّـطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُّضْغَةٍ مُّخَلَّقَةٍ وَّغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ لِّـنُبَيِّنَ لَـكُمْؕ وَنُقِرُّ فِىْ الْاَرْحَامِ مَا نَشَآءُ اِلٰٓى اَجَلٍ مُّسَمًّى ثُمَّ نُخْرِجُكُمْ طِفْلاً ثُمَّ لِتَبْلُغُوْۤا اَشُدَّكُمْۚ وَمِنْكُمْ مَّنْ يُّتَوَفّٰى وَمِنْكُمْ مَّنْ يُّرَدُّ اِلٰٓى اَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْلَا يَعْلَمَ مِنْۢ بَعْدِ عِلْمٍ شَيْـًٔـاؕ وَتَرَى الْاَرْضَ هَامِدَةً فَاِذَاۤ اَنْزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَآءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ وَاَنْۢبَـتَتْ مِنْ كُلِّ زَوْجٍۢ بَهِيْج ٍ
অর্থ: হে মানবজাতি! তোমরা পুনরুত্থান সম্পর্কে সন্দেহে থাকলে (জেনে রাখ) নিশ্চয় আমরা মাটি থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছিলাম, এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাটরক্ত থেকে, এরপর মাংসপিন্ড থেকে, যা বিশেষ সৃজন প্রক্রিয়ায় বা সাধারণ সৃজন প্রক্রিয়ায় বানানো হয়েছে যাতে আমরা তোমাদের সামনে (সৃষ্টি রহস্য) স্পষ্ট করে দিতে পারি: আর আমরা জরায়ুতে যা চাই (তা) এক নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত রাখি। এরপর আমরা এক শিশুরূপে তোমাদের বের করি – ফলে (পরবর্তীতে) তোমরা তোমাদের পরিপক্ক বয়সে পৌঁছে যাও। আর তোমাদের মাঝে এমন (লোকও) আছে যাদের চরম বার্ধক্যে নিয়ে যাওয়া হয়। (এর ফলে) তারা জ্ঞান লাভের পর সম্পূর্ণরূপে জ্ঞানহারা হয়ে পড়ে। আর তুমি ভূমিকে নিষ্প্রাণ দেখতে পাও। এরপর আমরা যখন এতে বৃষ্টি বর্ষণ করি তখন তা সজীব হয় আর ফুলে-ফেঁপে ওঠে এবং প্রত্যেক প্রকার উদ্ভিদের সবুজ শ্যামল শোভামন্ডিত জোড়া উৎপন্ন করে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: এই আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা মানব-জীবন সম্পর্কে স্বীয় সুন্নতের বা রীতির কথা বলেছেন। কেউ স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল পুরা হওয়ার পূর্বে মারা যায়, আর কেউ স্বাভাবিক জীবনকাল পূর্ণ করে এবং ধীরে ধীরে বয়সের এমন পর্যায়ে পৌঁছে যেখানে গিয়ে মানুষ জ্ঞান অর্জনের পর পুনরায় অজ্ঞতার শিকার হয়। এটিকে খোদা তা’লা স্বীয় নিয়ম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হযরত ঈসা (আ.) যদি এই নিয়মের ব্যতিক্রম হতেন তাহলে খোদা তা’লা অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন। পক্ষান্তরে খোদা তা’লা বলেন, তুমি তাঁর নিয়মে কোন ব্যতিক্রম দেখবে না। এই আয়াত থেকেও পরিস্কারভাবে বুঝা যায় যে, হযরত ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করেছেন।
فَاَزَلَّهُمَا الشَّيْطٰنُ عَنْهَا فَاَخْرَجَهُمَا مِمَّا كَانَا فِيْهِ وَقُلْنَا اهْبِطُوْا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ ۚ وَلَـكُمْ فِىْ الْاَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ اِلٰى حِيْنٍ
অর্থ: কিন্তু শয়তান তাদের উভয়ের স্খলন ঘটালো এবং তারা যেখানে ছিল সেখান থেকে তাদের বের করে দিল। আর আমরা বললাম, ‘তোমরা (সবাই এখান থেকে) চলে যাও। তোমাদের কতক কতকের শত্রু এবং তোমাদের জন্য (এ) পৃথিবীতে এক (নির্দিষ্ট) সময় পর্যন্ত থাকার ও জীবিকার উপকরণ রয়েছে’।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: অর্থাৎ তোমরা তোমাদের মাটির দেহ নিয়ে পৃথিবীতেই থাকবে এবং এই পৃথিবীর জীবনোপকরণ উপভোগের পর মৃত্যু বরণ করবে। এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, মাটির দেহ এই পৃথিবীতেই থাকবে, এই পৃথিবীর পরিবেশ সাথে না নিয়ে আকাশে যেতে পারে না। তাই বুঝা গেল যে, হযরত ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করেছেন। মাটিতে জন্ম এবং মাটিতে জীবন ধারণ করে মৃত্যুবরণ এই স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে ঈসা (আ.)-এর স্বশরীরে আকাশে গমন কোনভাবেই সাব্যস্ত নয়।
وَمَنْ نُّعَمِّرْهُ نُـنَكِّسْهُ فِىْ الْخَـلْقِؕ اَفَلَا يَعْقِلُوْنَ
অর্থ: আর আমরা যাকে দীর্ঘায়ু দান করি তাকে আমরা গঠনগত দিক থেকে দূর্বল করে দেই। অতএব তারা কি বিবেক খাটাবে না?
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: অর্থাৎ যাকে দীর্ঘায়ু দেই সে গঠনগত দিক থেকে দুর্বল হয়ে যায়, শক্তি সামর্থ হারিয়ে বসে, তার ইন্দ্রিয় দুর্বল হয়ে যায়, বুদ্ধিমত্তা লোপ পায়। হযরত ঈসা (আ.)-এর প্রেক্ষাপটে এ সবকিছু নিয়ে চিন্তা করুন। বুঝবেন যে, এই নীতি অনুসারে এখন তাঁর আর কিছু বাকী নেই, অবশ্যই তিনি ইন্তেকাল করেছেন।
اللّٰهُ الَّذِىْ خَلَقَكُمْ مِّنْ ضُعْفٍ ثُمَّ جَعَلَ مِنْۢ بَعْدِ ضُعْفٍ قُوَّةً ثُمَّ جَعَلَ مِنْۢ بَعْدِ قُوَّةٍ ضُعْفًا وَّشَيْبَةً ؕ يَخْلُقُ مَا يَشَآءُ ۚ وَهُوَ الْعَلِيْمُ الْقَدِيْرُ
অর্থ: আল্লাহ্ই তোমাদেরকে এক দুর্বল (অবস্থায়) সৃষ্টি করেছেন, আর দুর্বলতার পর শক্তি দিয়েছেন এবং শক্তি (দানের) পর দুর্বলতা ও বার্ধক্য দিয়েছেন। তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। আর তিনি সর্বজ্ঞ (ও) সর্বশক্তিমান।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: অর্থাৎ খোদা তোমাদের দুর্বল সৃষ্টি করেছেন, দুর্বলতার পর শক্তি দেন আবার শক্তির পর দুর্বলতা এবং বার্ধক্যে উপনীত করেন। এই আয়াত থেকেও বুঝা যায় যে, কোন মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মের ঊর্ধ্বে নয়। সকল সৃষ্টি এই নিয়মের অধীন। কাল্ তার জীবনকে প্রভাবিত করছে, আর এক পর্যায়ে কালের প্রভাবে সে মারা যায়। অতএব, হযরত ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করেছেন।
اِنَّمَا مَثَلُ الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا كَمَآءٍ اَنْزَلْنٰهُ مِنَ السَّمَآءِ فَاخْتَلَطَ بِهٖ نَبَاتُ الْاَرْضِ مِمَّا يَاْكُلُ النَّاسُ وَالْاَنْعٰمُؕ حَتّٰۤى اِذَاۤ اَخَذَتِ الْاَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ اَهْلُهَاۤ اَنَّهُمْ قٰدِرُوْنَ عَلَيْهَاۤ ۙاَتٰٮهَاۤ اَمْرُنَا لَيْلاً اَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنٰهَا حَصِيْدًا كَاَنْ لَّمْ تَغْنَ بِالْاَمْسِؕ كَذٰلِكَ نُـفَصِّلُ الْاٰيٰتِ لِقَوْمٍ يَّتَفَكَّرُوْنَ
অর্থ: পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত সেই পানির মত, যা আমরা আকাশ থেকে অবতীর্ণ করে থাকি। অতঃপর এর সাথে পৃথিবীর উদ্ভিদ মিলেমিশে যায়, যা থেকে মানুষ ও গবাদিপশু খেয়ে থাকে। অবশেষে পৃথিবী যখন নিজ পূর্ণ সৌন্দর্য ধারণ করে এবং সুশোভিত হয়ে ওঠে এবং এর মালিক একে নিজেদের কর্তৃত্বাধীন বলে মনে করে তখন রাতে বা দিনে অকস্মাৎ আমাদের সিদ্ধান্ত এসে পড়ে। এরপর আমরা একে এমন এক কর্তিত শস্য ক্ষেত্রের ন্যায় করে দেই যেন গতকাল এর কোন অস্তিত্বই ছিল না। চিন্তাশীল লোকদের জন্য আমরা এভাবেই নিদর্শনাবলী বিশদভাবে বর্ণনা করে থাকি।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: ইহজীবনকে তুলনা করা হয়েছে পানির সাথে, যার সংস্পর্শে বীজ অংকুরিত হয়। এরপর তা বড় হয়, বৃদ্ধি পায়, ফুলে-ফলে এবং সুষমামন্ডিত হয়, যা থেকে মানুষ ও অপরাপর প্রাণী খায় এবং লাভবান হয়, আর অবশেষে এর উপর আসে অবলুপ্তির পালা। অর্থাৎ মানুষ ও গাছপালা, উদ্ভিদ বা ফসলের ন্যায়, অর্থাৎ প্রথমে তা উৎকর্ষের দিকে যায় এরপর আসে ক্ষয়ে যাওয়ার পালা। প্রশ্ন হলো, হযরত মসীহ্ (আ.) কি এই প্রাকৃতিক নিয়মের ঊর্ধ্বে?
ثُمَّ اِنَّكُمْ بَعْدَ ذٰلِكَ لَمَيِّتُوْنَؕ
অর্থ: এরপর তোমরা অবশ্যই মারা যাবে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: খোদা তা’লা তোমাদের ধীরে ধীরে উৎকর্ষে পৌঁছান। উৎকর্ষে পৌঁছার পর তোমাদের ক্রম পতনের যুগ আসে, আর এক পর্যায়ে তোমরা মারা যাও। তোমাদের জন্য এটিই খোদার নিয়ম, কোন মানব এর বাহিরে নয়। হে খোদা! যারা হযরত ঈসা (আ.)-কে এর বাহিরে মনে করে, তুমি তাদের দৃষ্টি শক্তি দাও।
اَلَمْ تَرَ اَنَّ اللّٰهَ اَنْزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَسَلَـكَهٗ يَنَابِيْعَ فِىْ الْاَرْضِ ثُمَّ يُخْرِجُ بِهٖ زَرْعًا مُّخْتَلِفًا اَلْوَانُهٗ ثُمَّ يَهِيْجُ فَتَرٰٮهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَجْعَلُهٗ حُطَامًاؕ اِنَّ فِىْ ذٰلِكَ لَذِكْرٰى لِاُولِىْ الْاَلْبَابِ
অর্থ: তুমি কি দেখনি, আল্লাহ্ আকাশ থেকে পানি অবতীর্ণ করেন? এরপর তিনি ঝর্ণার আকারে একে ভূমিতে প্রবাহিত করেন। এরপর তিনি এর মাধ্যমে বিবিধ রং এর ফসল উৎপন্ন করেন। এরপর তা (পেকে বা না পেকে) শুকিয়ে যায়। এরপর তিনি একে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেন। নিশ্চয় এতে বুদ্ধিমানদের জন্য এক বড় উপদেশ রয়েছে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: এই আয়তগুলোতেও উপমা স্বরূপ একথাই বলা হয়েছে যে, মানুষ, শস্য বা উদ্ভিদের ন্যায় আয়ুষ্কাল পুরা করে এবং মারা যায়।
وَمَاۤ اَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنَ الْمُرْسَلِيْنَ اِلَّاۤ اِنَّهُمْ لَيَاْكُلُوْنَ الطَّعَامَ وَيَمْشُوْنَ فِىْ الْاَسْوَاقِؕ وَجَعَلْنَا بَعْضَكُمْ لِبَعْضٍ فِتْنَةً ؕ اَتَصْبِرُوْنَۚ وَكَانَ رَبُّكَ بَصِيْرًا
অর্থ: আর আমরা তোমার পূর্বে যত রসূলই পাঠিয়েছি তারা অবশ্যই খাবার খেত এবং হাটে বাজারে চলাফেরা করতো। আর আমরা তোমাদের একদলকে অন্য দলের জন্য পরীক্ষার কারণ করেছি (এটা দেখার জন্য যে) তোমরা ধৈর্য ধর কি না। আর তোমার প্রভু-প্রতিপালক সর্বদ্রষ্টা।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: অর্থাৎ আমরা তোমার পূর্বে যত রসূল পাঠিয়েছি তাঁরা সবাই খাবার খেতেন এবং বাজারে চলাফেরা করতেন অর্থাৎ তাঁরা সকলেই মানুষ ছিলেন। সাধারণ মানুষের মতই ছিল তাদের খাদ্যাহার ও চলাফেরা। অতএব তাদের প্রতি অতিমানবীয় বা অস্বাভাবিক কোন জীবনাচরণ আরোপ করা ঠিক নয়। জীবিত থাকার জন্য নবীরা যে খাবার খেতেন তা পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কেউ এর ব্যতিক্রম নন। অতএব হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্যও একই নিয়ম প্রযোজ্য। যেহেতু, সূরা আল্ মায়েদার ৭৬ নম্বর আয়াত অনুযায়ী তিনি এখন আর খান না, কাজেই তিনি যে মারা গেছেন তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হলো।
وَالَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ لَا يَخْلُقُوْنَ شَيْــًٔا وَّهُمْ يُخْلَقُوْنَؕ
اَمْوَاتٌ غَيْرُ اَحْيَآءٍۚ وَّمَا يَشْعُرُوْنَ اَيَّانَ يُبْعَثُوْنَ
অর্থ: আর আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে তারা যাদের ডাকে তারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না, বরং তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। (তারা সবাই) মৃত, জীবিত নয়। আর তাদের কখন পুনরুত্থিত করা হবে এ বিষয়ে তাদের কোন চেতনাই নেই।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে যাদের পূজা করা হয়, তারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট। তারা মৃত, জীবিত নয়; আর তারা জানে না কবে উত্থিত হবে। আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে যাদের পূজা করা হয় তাদের একজন হলেন হযরত ঈসা (আ.)। মানবগোষ্ঠির এক বিশাল অংশ হযরত ঈসাকে উপাস্য হিসেবে ডাকে। ত্রিত্ববাদী খ্রিষ্টানরা তাকে ঈশ্বরপুত্র ও ঈশ্বররূপে ডাকে। তাঁর কাছে সাহায্য চায় (নাউযুবিল্লাহ)। এই আয়াত বলছে, এমন সব উপাস্য ইন্তেকাল করেছে। এখনও যদি হযরত ঈসাকে মৃত না মানেন, তাহলে পরিস্কারভাবে বলেন না কেন যে, আমরা কুরআন মানি না।
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ اَبَآ اَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَلٰـكِنْ رَّسُوْلَ اللّٰهِ وَخَاتَمَ النَّبِيّٖنَ ؕ وَكَانَ اللّٰهُ بِكُلِّ شَىْءٍ عَلِيْمًا
অর্থ: মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মাঝে কারো পিতা নয়। কিন্তু সে আল্লাহ্র রসূল ও নবীদের মোহর। আর আল্লাহ্ প্রত্যেক বিষয়ে পুরোপুরি অবগত।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.) তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয় কিন্তু তিনি আল্লাহ্র রসূল এবং নবীদের সমাপ্তকারী। অর্থাৎ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর আগমনের মাধ্যমে শরিয়তের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এখন আর ভিন্ন শরিয়তের কোন নবীর আসার সুযোগ বা অবকাশ নেই, কেননা তিনি (সা.) খাতামান্ নবীঈন। তাই বুঝা গেল যে, হযরত ঈসা (আ.) পুনরায় পৃথিবীতে আসতে পারেন না। কেননা হযরত ঈসা (আ.)-কে যদি পৃথিবীতে নবুয়ত করতে হয় তাহলে জিব্রাইলের মাধ্যমে তাঁর প্রতি কুরআন নাযিল করা ও শরিয়ত অবতীর্ণ হবার বিষয়টি সাব্যস্ত হয়। কিন্তু আমরা জানি যে, রিসালত সম্বলিত ওহী কিয়ামত পর্যন্ত এখন আর আসতে পারে না। কাজেই, খতমে নবুয়ত ভঙ্গ করে পূর্ববর্তী ঈসার আসার আর কোন সুযোগ নেই।
وَمَاۤ اَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ اِلَّا رِجَالاً نُّوْحِىْۤ اِلَيْهِمْ فَسْــَٔلُوْۤا اَهْلَ الذِّكْرِ اِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَۙ
অর্থ: আর আমরা তোমার পূর্বে কেবল পুরুষদেরই (রসূলরূপে) প্রেরণ করেছি যাদের প্রতি আমরা ওহী করতাম। অতএব তোমাদের জানা না থাকলে ঐশী গ্রন্থাবলীর তত্ত্বাবধায়কদের জিজ্ঞেস কর।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: অর্থাৎ ধর্মের ক্ষেত্রে যদি তোমরা এমন বিষয়ের মুখাপেক্ষী হও যা সম্পর্কে তোমাদের জ্ঞান নেই তাহলে তোমরা কিতাবের ইতিহাসের সূত্রে বিষয়টি যাচাই কর এবং তাদের গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাবলীর প্রতি দৃষ্টি দাও তাহলে বিষয় পরিস্কার হয়ে যাবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের দেখা উচিত যে, তাদের গ্রন্থে অতীতের কোন নবীর আগমনের সংবাদ দেয়া হয়ে থাকলে, পূর্বের নবীই কি এসেছেন নাকি এমন বাক্যের অন্য কোন অর্থ আছে? আমরা জানি যে, এই বিতর্কিত বিষয়ের মিমাংসা হযরত ঈসা (আ.) স্বয়ং করে গেছেন; আর তাঁর সিদ্ধান্তের সাথে আমাদের সিদ্ধান্তের সাদৃশ্য আছে। রাজাবলী এবং মালাখি নবীর বই দেখুন! যেখানে এলিয়া নবীর দ্বিতীয় আগমনের সংবাদ আছে। হযরত ঈসা (আ.) যখন খোদার পক্ষ থেকে প্রেরিত হওয়ার দাবী করলেন তখন ইহুদীরা তাঁকে জিজ্ঞেস করল যে, এলিয়া কোথায়? কেননা, ঈসার আসার পূর্বে এলিয়ার আসার কথা! উত্তরে তিনি ইয়াহিয়ার দিকে ইশারা করে বলেন যে, ইনিই এলিয়া; ইচ্ছা হয় মান অথবা অস্বীকার কর। সুতরাং পূর্ববর্তী কোন নবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী থাকলে আক্ষরিক অর্থে কোন নবীর আগমন বুঝায় না বরং তাঁর গুণে গুণান্বিত কোন ব্যক্তির আগমনকে বুঝায়।
يٰۤاَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَٮِٕنَّةُ
ارْجِعِىْۤ اِلٰى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً
فَادْخُلِىْ فِىْ عِبٰدِىۙ
وَادْخُلِىْ جَنَّتِى
অর্থ: হে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রভু-প্রতিপালকের দিকে ফিরে আস এমন অবস্থায় যে তুমি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট। অতএব তুমি আমার বান্দাদের অর্ন্তভূক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: হে আরামপ্রাপ্ত আত্মা ও প্রশান্ত আত্মা! তোমার প্রভুর দিকে ফিরে আস আর আমার সেসব বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত হও যারা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে আর আমার জান্নাতে প্রবেশ কর। এই আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, মানুষ যতদিন ইন্তেকাল না করে ততদিন অতীত লোকদের সাথে মিলিত হতে পারে না। মি’রাজের হাদীস, বুখারী শরীফে যার উল্লেখ আছে, তা থেকে পরিস্কারভাবে বুঝা যায় যে, হযরত ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করেছেন; কেননা এতে হযরত ঈসা (আ.) মৃতদের শ্রেণীভূক্ত ছিলেন আর হযরত ইয়াহিয়া এবং অন্যান্য নবীরাও তাঁর সাথে ছিলেন।
اللّٰهُ الَّذِىْ خَلَقَكُمْ ثُمَّ رَزَقَكُمْ ثُمَّ يُمِيْتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيْكُمْؕ هَلْ مِنْ شُرَكَآٮِٕكُمْ مَّنْ يَّفْعَلُ مِنْ ذٰلِكُمْ مِّنْ شَىْءٍؕ سُبْحٰنَهٗ وَتَعٰلٰى عَمَّا يُشْرِكُوْنَ
অর্থ: তিনিই আল্লাহ্, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, এরপর তোমাদের রিয্ক দান করেছেন, এরপর তিনি তোমাদের মৃত্যু দিবেন (এবং) এরপর তিনি তোমাদের জীবিত করবেন। তোমাদের (কল্পিত) শরীকদের মাঝেও কি (এমন) কেউ আছে, যে এসবের কোনটি করতে পারে? তিনি অতি পবিত্র এবং (তাঁর সাথে) তারা যা শরীক করে তিনি এর অনেক ঊর্ধ্বে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: এই আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন, মানব জীবনের উল্লেখযোগ্য ধাপ কেবল চারটি। প্রথমে তার জন্ম হয়, তারপর পরিপূর্ণতার উদ্দেশ্যে আধ্যাত্মিক ও দৈহিক জীবিকা দেয়া হয়। এরপর মৃত্যু আসে, অতঃপর পুনরুজ্জীবিত হয়। এ আয়াতে এমন কোন শব্দ নাই যার আলোকে বলা যেতে পারে ঈসা (আ.) এই নিয়মের ব্যতিক্রম।
كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ
وَّيَبْقٰى وَجْهُ رَبِّكَ ذُوْ الْجَلٰلِ وَالْاِكْرَامِ
অর্থ: এ (পৃথিবীতে) যা কিছু আছে সবই নশ্বর কেবল তোমার মহা-প্রতাপশালী ও মহাসম্মানিত প্রভু-প্রতিপালকের সত্তাই অবিনশ্বর।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: যা কিছু পৃথিবীতে আছে আর যা কিছু ভূমি থেকে উদ্গত হয় তা সবই নশ্বর, অর্থাৎ তা ধীরে ধীরে ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। কেউ এই অমোঘ বিধানকে এড়াতে পারে না। এ কারণেই শিশু – যৌবনে পৌঁছে, যুবক – বৃদ্ধ হয় আর বৃদ্ধ কবরে নিক্ষিপ্ত হয়। আল্লাহ্ ফা’নিন শব্দ বেছে নিয়েছেন ইয়াফনি নয়; এর উদ্দেশ্য একথা বুঝানো যে, এর ক্ষয় এমন নয় যা ভবিষ্যতে কোন সময় হবে বরং এখনই হচ্ছে। কিন্তু অনেকের ধারণা হযরত ঈসার উপর এই চির সত্যের কোন প্রভাব নেই অথচ খোদা মসীহ্ (আ.)-কে এই নিয়মের ব্যতিক্রম আখ্যা দেন নি।
اِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِىْ جَنّٰتٍ وَّنَهَرٍۙ
فِىْ مَقْعَدِ صِدْقٍ عِنْدَ مَلِيْكٍ مُّقْتَدِرٍ
অর্থ: নিশ্চয় মুত্তাকীরা জান্নাতসমূহে থাকবে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে (থাকবে) এক চিরস্থায়ী মর্যাদার আসনে, সর্বশক্তিমান অধিপতির সান্নিধ্যে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: মুত্তাকী – ত্বাক্ওয়া বা খোদা প্রেমের কারণে সর্বশক্তিমান ও সর্বাধিপতির কাছে জান্নাতে আর নহরে থাকবেন। এ আয়াতে খোদা তা’লার কাছে যাওয়া এবং জান্নাতে প্রবেশ করা, একই সূত্রে গাঁথা। তাই রাফি’উকার অর্থ যদি খোদার কাছে উত্থিত হওয়া করা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে এই আয়াত অনুসারে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করেছেন। এথেকে বুঝা যায় যে, খোদা তা’লার দিকে উত্থিত হওয়া, জান্নাতে প্রবেশ এবং অতীত পুণ্যাত্মাদের সাথে মিলিত হওয়ার কাজ একই সময়ে ঘটে। অতএব, এই আয়াত থেকেও বুঝা যায় যে, মসীহ্ ইবনে মরিয়ম (আ.) ইন্তেকাল করেছেন।
اِنَّ الَّذِيْنَ سَبَقَتْ لَهُمْ مِّنَّا الْحُسْنٰٓىۙ اُولٰٓٮِٕكَ عَنْهَا مُبْعَدُوْنَۙ
لَا يَسْمَعُوْنَ حَسِيْسَهَاۚ وَهُمْ فِىْ مَا اشْتَهَتْ اَنْفُسُهُمْ خٰلِدُوْنَ
অর্থ: নিশ্চয় যাদের জন্য পূর্ব হতে আমাদের পক্ষ থেকে কল্যাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে এ (জাহান্নাম) থেকে তাদের দূরে রাখা হবে। তারা এর ক্ষীণ শব্দও শুনবে না। আর তাদের মন যেভাবে চায় সে অবস্থায় তারা চিরকাল থাকবে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: অর্থাৎ জান্নাতবাসীদের জান্নাতী হওয়া আমাদের পক্ষ থেকে প্রমাণিত হয়েছে। এমন মানুষ জাহান্নাম থেকে দূরে এবং জান্নাতে স্থায়ী আনন্দের মাঝে বসবাস করবেন। এই আয়াতে ওজাইর এবং হযরত মসীহ্-র কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা যে জান্নাতে প্রবেশ করেছেন তা প্রমাণিত হয় এবং জান্নাতে প্রবেশের অর্থ হলো, তাঁরা ইন্তেকাল করেছেন। মহানবী (সা.), হযরত ঈসা (আ.)-কেও অন্যান্য নবীদের সাথে জান্নাতে দেখেছেন।
اَيْنَ مَا تَكُوْنُوْا يُدْرِككُّمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِىْ بُرُوْجٍ مُّشَيَّدَةٍؕ وَاِنْ تُصِبْهُمْ حَسَنَةٌ يَّقُوْلُوْا هٰذِهٖ مِنْ عِنْدِ اللّٰهِۚ وَاِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَّقُوْلُوْا هٰذِهٖ مِنْ عِنْدِكَؕ قُلْ كُلٌّ مِّنْ عِنْدِ اللّٰهِؕ فَمَالِ ھٰٓؤُلَآءِ الْقَوْمِ لَا يَكَادُوْنَ يَفْقَهُوْنَ حَدِيْثًا
অর্থ: তোমরা যেখানেই থাক, এমনকি এক সুরক্ষিত দুর্গে থাকলেও মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই। আর তাদের কোন কল্যাণ হলে তারা বলে, ‘এটা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে’। আর কোন অনিষ্ট হলে বলে, ‘(হে মুহাম্মদ!) এটা তোমার কারণেই ঘটেছে।’ তুমি বল, ‘সব আল্লাহ্রই পক্ষ থেকে হয়ে থাকে’। অতএব এ লোকগুলোর হয়েছে কী, এরা যে মোটেও কথা বুঝতে চায় না!
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: তোমরা যেখানেই থাক মৃত্যু তোমাদের ধৃত করবে। এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, মৃত্যু ও মৃত্যুর আনুষঙ্গিক দিকগুলো সর্বত্র মানুষের সাথে লেগেই আছে। এটিই খোদার রীতি। এখানে আদৗ বলা হয়নি যে, মসীহ্ (আ.) এই নিয়মের বাহিরে। কাজেই এই আয়াতে উল্লেখিত ইশারা মোতাবেক হযরত ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যু যে পিছু ধাওয়া করে এর অর্থ হলো, দুর্বলতা-বার্ধক্য এবং রোগ-ব্যাধি যা মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। কোন সৃষ্টিই এই নিয়মের ঊর্ধ্বে নয়।
مَاۤ اٰتٰٮكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَ مَا َنَهٰٮكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوْاۚ
অর্থ: রসূল তোমাদের যা দান করে তা নিয়ে নাও এবং যা থেকে তোমাদের বিরত করে তা থেকে বিরত হও।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: মিশকাত শরীফের হাদীসে মহানবী (সা.)-এর উক্তি আছে যে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, আমার উম্মতের লোকদের বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বয়স হবে ৬০ থেকে ৭০। এমন মানুষ অতি বিরল হবে যারা এই বয়ঃসীমা অতিক্রম করবে। এটি স্পষ্ট যে, হযরত ঈসা উম্মতভূক্ত; তাই প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, মানুষ যেখানে বড় কষ্টে ৭০ বছর বয়স পাচ্ছে, সেখানে কিভাবে তিনি অনায়াসে ২০০০ বছর জীবিত আছেন! আর এখনও মরার নামই নিচ্ছেন না বরং বলা হয় যে, পৃথিবীতে এসে ৪০ বছর জীবিত থাকবেন।
অপর হাদীসে আছে যে, মহানবী (সা.) কসম খেয়ে বলতেন, এই পৃথিবীর কোন সৃষ্টি একশত বছর পর জীবিত থাকবে না। অর্থাৎ, যাদের সৃষ্টি এখানে হয়েছে তারা একশত বছরের বেশী জীবিত থাকবে না। অতএব হযরত ঈসা (আ.)-এর যেহেতু এ পৃথিবীতেই জন্ম তাই তিনি জীবিত নেই। এ হলো রসূল (সা.)-এর দেয়া সিদ্ধান্ত; গ্রহণ বা বর্জন করা আপনার ইচ্ছা।
اَوْ يَكُوْنَ لَـكَ بَيْتٌ مِّنْ زُخْرُفٍ اَوْ تَرْقٰى فِىْ السَّمَآءِؕ وَلَنْ نُّـؤْمِنَ لِرُقِيِّكَ حَتّٰى تُنَزِّلَ عَلَيْنَا كِتٰبًا نَّـقْرَؤُهٗؕ قُلْ سُبْحَانَ رَبِّىْ هَلْ كُنْتُ اِلَّا بَشَرًا رَّسُوْلاً
অর্থ: অথবা তোমার সোনার কোন ঘর না হওয়া পর্যন্ত অথবা তুমি আকাশে উঠে না যাওয়া পর্যন্ত (আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনবো না)। কিন্তু আমরা তোমার (আকাশে) উঠার ব্যাপারটিও কখনো বিশ্বাস করবো না যতক্ষণ তুমি আমাদের জন্য এমন কোন কিতাব (সেখান থেকে) নামিয়ে না আনবে যা আমরা পড়তে পারি। তুমি বল, ‘আমার প্রভু-প্রতিপালক (এসব থেকে) পবিত্র। আমি তো কেবলমাত্র একজন মানুষ-রসূল।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: কাফিররা মহানবী (সা.)-এর কাছে দাবী করে যে, আকাশে আরোহণের মত নিদর্শন দেখাও। তিনি (সা.) তাদের বলেন, এই মাটির দেহের আকাশে যাওয়া খোদার রীতি ও নিয়ম পরিপন্থী। কিন্তু যদি হযরত ঈসার মাটির দেহ আকাশে যায়, তাহলে মহানবীর এই উক্তি প্রশ্নবানে জর্জরিত হবে; আর খোদার কথায় স্ববিরোধ দেখা দেবে। তাই, নিশ্চিত সত্য কথা হলো, হযরত ঈসা (আ.) জীবিত স্বশরীরে আকাশে যাননি; বরং মৃত্যুর পর আকাশে গিয়েছেন – যেভাবে হযরত ইয়াহিয়া, আদম, ইদ্রিস ও হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে আকাশে উঠানো হয়েছে।
পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত আয়াতসমূহের আলোকে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইস্রাঈলী জাতির রসূল হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) আকাশে যান নি বরং এই ধরাপৃষ্ঠে রিসালতের দায়িত্ব পালনের পর স্বাভাবিকভাবে ইন্তেকাল করেছেন। অতএব এই উম্মতে আগমনকারী ঈসা ভিন্ন এক ব্যক্তি হবেন, যিনি ঈসা (আ.)-এর গুণ ও বৈশিষ্ট্য সহকারে আবির্ভূত হবেন। এখন, জাগ্রত বিবেকের কাছে আমাদের অনুরোধ – পবিত্র কুরআনের অকাট্য প্রমাণের উপর নির্ভর করুন, কেননা একদিন খোদার কাছে সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে।
(প্রাপ্ত সূত্র: কেন্দ্রীয় বাংলা ডেস্ক, লন্ডন, ইউকে)
Leave a Reply